গল্পের ঝুলি : সাহেব বাড়ির জঙ্গলে : সায়ন্তনী পলমল ঘোষ




“ এবারও ওই ঘন্টাওয়ালার ছেলে ফাস্ট হয়ে গেল আর তুই শ্রীধর পালুইয়ের ছেলে হয়ে প্রথম পাঁচজনের বাইরে! দ্যাখো দ্যাখো তোমার ছেলের কীর্তি। আবার পয়লা জানুয়ারি বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক করবে বলে টাকা চাওয়া হচ্ছিল!”

“ হ্যাঁর, পল্টু, তোর পেছনে তোর বাবা যে এতগুলা মাস্টার দিয়েছে তাতে লাভটা কি হলো শুনি?”

বাবা-মায়ের উপর্যুপরি আক্রমণে ঘাড় গোঁজ করে চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে রইল পল্টু। মনের ভেতরে তার দাবানলের আগুন। ওই ঘন্টাওয়ালার ছেলে কৃষ্ণকে সে দেখে নেবে। সুন্দরগড় গ্রামের রানুবালা স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস নাইনের ছাত্র পল্টু। তার বাবা শ্রীধর পালুই মস্ত আড়ৎদার। গ্রামের অন্যতম ধনী ব্যক্তি, সেই কারণে তাঁদের পুরো পরিবারেরই অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। ছেলের পড়াশোনার জন্য হয়ত প্রয়োজনের অতিরিক্তই তিনি খরচ করেন। তাঁর ছেলেকে কেউ টপকে যাবে এটা মানতে তাঁর ভীষণ কষ্ট। পল্টুও সহজে মেনে নিতে পারে না কিন্তু মুশকিল হলো সে কোনও দিনই একেবারে প্রথম দিকে থাকতে পারে না। কৃষ্ণ, অর্ক, মোহন, জিৎ এরা সবাই তার চেয়ে এগিয়ে থাকে। এদের কাউকেই পল্টু সহ্য করতে পারে না তবে তার সবচেয়ে বেশী রাগ ফার্স্ট বয় কৃষ্ণর ওপর। কৃষ্ণ ক্লাসে প্রথম হয় বলে যতটা না কৃষ্ণ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীর ছেলে হয়ে 
ফার্স্ট হয় সেইজন্য বোধহয় রাগটা আরও বেশি। বাকিদের সবার আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। কৃষ্ণকে নিয়ে অবশ্য পল্টু ছাড়া আর কারুর কোনও সমস্যা নেই বরং স্কুলের শিক্ষকরা থেকে শুরু করে ছাত্ররা সবাই তার মধুর ব্যবহারের জন্য তাকে খুব ভালোবাসে। কৃষ্ণর বাবা স্কুলে ঘন্টা বাজায়। সেই ঘন্টাওয়ালার ছেলে হয়ে কৃষ্ণ ক্লাসে ফার্স্ট হবে, সবার নয়নের মণি হয়ে থাকবে এটা ভাবলেই পল্টুর মাথায় আগুন জ্বলে যায়।

প্রীতম স্যারের বাড়ি থেকে ফিরছিল কৃষ্ণ। স্যারেরা তাকে খুব সাহায্য করেন। বিনা পয়সায় পড়া বুঝিয়ে দেন। কৃষ্ণও তাঁদের এই ভালোবাসা, বিশ্বাসের মর্যাদা রাখার চেষ্টা করে। শীতের বিকেল বলে দিনের আলো থাকলেও এখনই বেশ ঠান্ডা লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণ যখন ফুটবল মাঠের কাছে এসেছে তখনই শুনতে পেল, “ কৃষ্ণ একটু এদিকে শুনবি ভাই।” কৃষ্ণ অবাক হয়ে গেল বিনোদকে দেখে। বিনোদ পল্টুর খুব ভালো বন্ধু। ওদের একটা দলও আছে। ওরা যে কেউ কৃষ্ণকে খুব একটা পছন্দ করে না সেটাও কৃষ্ণর খুব ভালো করেই জানা আছে। আজ হঠাৎ বিনোদ ওকে ডাকছে কেন! “ ভাই, তুই কি আমার ওপর রাগ করেছিস?” নরম গলায় বলল বিনোদ।

“ না, না তা কেন? কী বলছিস বল না?”

“ ভাই, এই অংকগুলো আমাকে একটু বুঝিয়ে দিবি? বুঝতেই তো পারছিস পল্টু জানলে আমাকে...।” মাথা নিচু করে বলে বিনোদ।

“ আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বুঝিয়ে দেব।” স্মিত হেসে বলে কৃষ্ণ।

“ তাহলে ওই গাছটার তলায় বসে চট করে বুঝিয়ে দে। এখানে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না। এখনও দিনের আলো যায়নি। সব ক'টা অঙ্কই হয়ে যাবে।”

“ আচ্ছা, চল।”



আস্তে আস্তে চোখ মিলে তাকালো কৃষ্ণ। মাথার ওপর তারায় ভরা রাতের আকাশ। প্রথমে খানিকক্ষণ মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল তারপর আস্তে আস্তে সব মনে পড়লো তার। বিনোদ তাকে বটগাছটার কাছে নিয়ে গেল তারপর তার মাথায় কেউ আঘাত করল। তারপর আর কিছু মনে নেই তার। ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাওয়ার উপক্রম তাও উঠে বসার চেষ্টা করল কৃষ্ণ। সব বুঝতে পারছে সে। পল্টুরা একটা ফাঁদ পেতেছিল তার জন্য আর বোকার মত সেই ফাঁদে সে পা দিয়ে ফেলেছিল। রেজাল্ট বেরোনোর পরই জিৎ তাকে বলেছিল যে পল্টু রাগে ফুঁসছে তার ওপর কিন্তু ওরা এত মারাত্মক একটা কাজ করবে কৃষ্ণ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। কিন্তু এটা কোন জায়গা বুঝতে পারছে না সে। তার চেনা কোনও জায়গা নয়। উঠে বসে বোঝার চেষ্টা করলো কৃষ্ণ। সে একটা ফাঁকা জমিতে বসে আছে কিন্তু চারপাশে বড়, বড় গাছের জঙ্গল, ঝোপঝাড়। খানিক পরে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো কৃষ্ণর। এটা সাহেব বাড়ির জঙ্গল নয় তো? সুন্দরগড়ের উত্তর প্রান্তে এই সাহেব বাড়ির জঙ্গল। জ্ঞান হওয়া ইস্তক এই জঙ্গলের দুর্নাম শুনে আসছে কৃষ্ণ। তাদের গ্রামের কেউ এই জঙ্গলে ঢোকে না, বিশেষ করে সূর্য ডোবার পর তো নয়ই। দাদুর মুখে কৃষ্ণ শুনেছে সূর্যাস্তের পরে যারাই এই জঙ্গলে ঢুকেছে আর কোনও দিন বেরিয়ে আসেনি জঙ্গল থেকে। তারও কি এই অবস্থা হবে নাকি! কনকনে ঠান্ডা হওয়ায় হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ক্রমশ একটা অজানা ভয় জাঁকিয়ে বসছে তার মনে। নিজের বুকের ধুকপুক আওয়াজ নিজেই শুনতে পাচ্ছে কৃষ্ণ। “ বিপদে সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখবে। দেখবে ঠিক পথের দিশা খুঁজে পাবে তুমি।” বাংলা স্যারের বলা কথাগুলো হঠাৎ করেই কৃষ্ণর মনে মধ্যে উঁকি দিল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো সে। দুধসাদা জ্যোৎস্নায় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। আন্দাজে ভর করে সে একদিকে হাঁটা শুরু করল। খানিকক্ষণ হাঁটার পর সে বুঝতে পারলো জঙ্গলের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে সে। এখানে চাঁদের আলোও ভালো ঢুকছে না। আবার দিক পরিবর্তন করে হাঁটা শুরু করল কৃষ্ণ। খিদেয় পেট কামড়াচ্ছে, ভীষণ শীত করছে কিন্তু সে নিরুপায়। কিছুটা হাঁটার পর অবাক হয়ে গেল কৃষ্ণ তার সামনে একটু উঁচু জমির ওপর একটি পুরানো আমলের বাংলো বাড়ি। কয়েক মুহূর্ত ভেবে সাহসে ভর করে এগিয়ে গেল সে। মনে মনে সে বুঝেই গেছে এই জঙ্গল থেকে বেঁচে ফেরা প্রায় অসম্ভব। তাহলে আর ভয় কী তার? শুধু বাড়ির সকলের জন্য মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তারা তো জানবেও না কৃষ্ণ কোথায়।



----- হু ? হু ইজ দেয়ার? 

নিখুঁত সাহেবি উচ্চারণ শুনে চমকে উঠল কৃষ্ণ। দোনামনা করে কেটে কেটে বলল,” আয়াম কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষ। আই লিভ ইন সুন্দরগড়।”

বাংলো থেকে কালো কোট প্যান্ট আর ফেল্ট হ্যাট পরা এক সাহেব বেরিয়ে এলেন।

-----ওহ, কাউয়ার্ড,ইললিটারেট বেঙ্গালি বয়।

“ কাওয়ার্ড, ইললিটারেট বেঙ্গালি” শব্দগুলো শুনেই কৃষ্ণর মাথাটা গরম হয়ে গেল।

-----টুমরা বাঙালিরা একডাম ওয়ার্থলেস আছো।

------আপনি এভাবে আমাদের অপমান করছেন কেন? 

ঝাঁঝিয়ে উঠলো কৃষ্ণ।

-----টুমি হামার সাথে এমনি বেহেভ করিতেছ। টুমি জানো হামি কে আছি?

----জানি না কিন্তু আপনি যেই হোন না কেন মোটেই ভালো মানুষ নন।

------ আয়াম জোস থমাস। আ রিয়াল ব্রিটিশ। দাম্ভিক কণ্ঠে বললেন সাহেব।

“ জোস থমাস” নামটা শুনেই চমকে উঠলো কৃষ্ণ। ওদের পাড়ার সুদীপকাকু কলকাতার একটা কলেজে ইতিহাস পড়ায়। সুদীপকাকু নিয়মিত ইতিহাস নিয়ে চর্চা করে। তার কাছেই কৃষ্ণ একবার শুনেছিল যে ইংরেজ আমলে তাদের এই সুন্দরগড়ে সাহেবদের খুব অত্যাচার ছিল। তেমনি এক সাহেব ছিলেন জোস থমাস। অত্যন্ত অহংকারী ছিলেন। প্রচন্ড জাত্যাভিমান ছিল তাঁর মধ্যে। নেটিভদের সংস্পর্শে থাকবেন না বলে গ্রামের বাইরে জঙ্গলের ধারে বাংলো বানিয়েছিলেন। তখন জঙ্গল আকারে এত বড় ছিল না। জোস থমাসের অত্যাচার দিনকে দিন বেড়েই চলছিল। একই সাথে সেইসময় সুন্দরগড় আর তার আশেপাশের গ্রামে গোপনে বিপ্লবী দল গড়ে উঠছিল। শেষে একদিন বিপ্লবীরা থমাসের বাংলো আক্রমণ করে এবং থমাসকে গুলি করে মারে। জনশ্রুতি থমাস মারা গেলেও তার আত্মা এই অঞ্চল ছেড়ে কোথাও যায়নি। থমাসের মৃত্যুর পরও অনেকে বাংলোর কাছাকাছি তাকে দেখতে পেত। থমাসের মৃত্যুর পর দুজন রাখালকে বাংলোর সামনে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। তারপর থেকে গ্রামের মানুষ বাংলো চত্বর এড়িয়ে চলতে শুরু করে। কালের নিয়মে ধীরে ধীরে জঙ্গল বেড়ে আরও এগিয়ে আসে আর সাহেবের বাংলো জঙ্গলের ভেতরে পড়ে যায়। তবে আজও সন্ধ্যের পর কেউ এই জঙ্গলে ঢুকলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই জঙ্গলে নাকি বিভিন্ন রকম অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে তাই দিনের বেলাও পারতপক্ষে কেউ এদিক পানে আসে না। 



কৃষ্ণ বুঝতে পারলো সাক্ষাৎ মৃত্যু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর বেঁচে ফেরার কোনও আশা নেই এই কথাটা উপলব্ধি করার সাথে সাথে কৃষ্ণর মনের মধ্যে থেকে সমস্ত ভয়,আশঙ্কা দূর হয়ে গেল। তার মনে হলো বহু বছর আগে যেমন একদল তরুণ বিপ্লবী থমাসকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল তেমনি আজ থমাস তাকে মেরে ফেলার আগে থমাসকে অন্তত দু'চার কথা হলেও শুনিয়ে যাবে সে। সাহেবের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলো সে, 

“বাঙালিরা যদি এতই কাউয়ার্ড তাহলে বাঙালিদের গুলি খেয়ে মারা গেলেন কেন? তাদের সাথে লড়াই করে তাদের হারাতে পারলেন না কেন?” 
সাহেবের ভূত খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। বোধহয় পুঁচকে একটা বাঙালী ছেলের সাহস দেখে একটু অবাক হলো। কয়েক মিনিট পর গলা ঝেড়ে সাহেব বলল, “ ওককে বাট বেঙ্গালীস আর সো ইললিটারেট।”

-----আপনি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শোনেন নি? জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম শোনেন নি? আপনি বোধহয় তার আগেই ….। জানেন এখন সবাই কত লেখাপড়া করে। আমাকে দেখুন আমি হলাম রানীবালা স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস নাইনের ফার্স্ট বয়। স্যারেরা কত কিছু পড়ান আমাদের জানেন?

------ডু ইউ নো ইংলিশ, হিস্ট্রি, জিওগ্রাফি, ম্যাথস? সন্দিগ্ধ স্বরে বলল সাহেব।

------ইয়াহ। আই গট হান্ড্রেড আউট অফ হান্ড্রেড ইন ম্যাথস।

-----ওহ, রিয়ালি!

------আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে নাকি?

------হুম, চল টাহলে টমার ম্যাথস টেস্ট নিই।

-----ঠিক আছে। চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্টেড। তবে একটা শর্ত আছে আমার যদি আমি অঙ্ক কষতে পারি আপনাকে এই জঙ্গল ছেড়ে চলে যেতে হবে।

একটু ভেবে সাহেব উত্তর দিলেন, “ ওকে, ডান।”



পুরো ঘরটা অন্ধকার শুধু মাঝখানে ছোট্ট একটা ডিম্বাকৃতি টেবিলের ওপর মোমদানিতে একটা মোমবাতি জ্বলছে। এখানে শীতটাও আর তেমন অনুভূত হচ্ছে না। টেবিলের দুই দিকে দুটি চেয়ার। এইটা বাংলোর সামনের ঘর। সাহেব এখানেই এনেছে কৃষ্ণকে অঙ্ক কষার জন্য। চেয়ারে বসে সাহেব কৃষ্ণর দিকে টেবিলে রাখা খাতা,পেনটা বাড়িয়ে দিল। সাহেবের মুখে মুচকি হাসি। খাতার পাতাটার দিকে তাকিয়েই কৃষ্ণর মুখটা শুকিয়ে গেল। সাদা পাতায় একটা অঙ্ক দেওয়া আছে কিন্তু এসব অঙ্ক তো কৃষ্ণ জানে না। এই ধরনের অঙ্ক রূপমদাদাকে কষতে দেখেছে কৃষ্ণ। রুপম দাদা কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অঙ্ক নিয়ে পড়ে। কৃষ্ণ সাহেবের চালাকিটা বুঝতে পারলো। তাকে এমন অঙ্ক দিয়েছে যা তার সাধ্যের বাইরে।

----পেনটা হাতে নাও।

কে যেন ফিসফিস করে কৃষ্ণর কানের কাছে বলল। একটু চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে পেনটা হাতে নিয়ে খাতাটা কাছে টেনে নিল কৃষ্ণ। সাহেব বাড়ির জঙ্গলে অনেক কিছুই হতে পারে। খাতায় বসাবার সাথে সাথে পেনটা উইসন বোল্টের গতিতে ছুটতে লাগলো। পাতার পর পাতা অঙ্ক কষে চলেছে কৃষ্ণ থুড়ি পেনটা। কৃষ্ণ শুধু পেনটা ধরে আছে। একসময় খাতার পাতা শেষ হলো। সব কটা অঙ্ক কষে ফেলেছে কৃষ্ণ। পেনটা নামিয়ে সাহেবের দিকে তাকালো সে। সাহেবের চোখদুটো গোল গোল হয়ে গেছে।

-----ইম্পসিবল। ইটস রিয়ালি ইম্পসিবল। ইউ কান্ট ডু দিস।

------কেন থমাস সাহেব? কেন করতে পারি না? বাঙালী বলে? আপনি তো হিন্দী সিরিয়ালের ভাটাকটি আত্মাদের মত এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এত বছর ধরে। বাঙালী যে এখন লিলুয়া থেকে লন্ডন, বনগাঁ থেকে বোস্টন সব জায়গায় নিজের ক্যারিশমা দেখিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সে খবর তো রাখেন না। বাঙালী সুভাষ চন্দ্র বসু কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন আপনার ব্রিটিশ সরকারকে। আচ্ছা, ভারত যে এখন স্বাধীন এই খবরটা জানেন নাকি সেটাও জানেন না?

-----কী বলিলে টুমি? ইন্ডিয়া ইজ নাও আ ইন্ডিপেন্ডেন্ট কান্ট্রি! 

চরম বিস্ময় সাহেবের গলায়।

------ইয়েস, স্যার। আপনার জাতভাইরা এদেশ ছেড়ে বহুদিন হল চলে গেছেন। তাই বলছি শর্ত অনুযায়ী আপনিও এবার এই জঙ্গল ছেড়ে চলে যান। এত বছরে অনেক জ্বালিয়েছেন এই অঞ্চলের লোকেদের।

সাহেব তুম্বো মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। বোধহয় কৃষ্ণর কথাগুলো শুনে হজম করতে কষ্ট হচ্ছে।

-----কী হলো সাহেব? ব্রিটিশরা এককথার মানুষ বলে আমি শুনেছিলাম মনে হচ্ছে।

----ওককে, ওককে। আমি আর এই নেটিভদের দেশে থাকিব না। আমি চলিলাম টেমসের হাওয়া খাইটে।

দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল সাহেব।

সাহেব ভুস করে ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল আর কৃষ্ণ অবাক হয়ে দেখল কোথায় সুন্দর সেই বাংলো বাড়ি! সে একটা ভগ্নস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে সেই ভগ্নস্তূপের বাইরে বেরিয়ে এল কৃষ্ণ। চারিদিক নিঝুম।

-----তুমি তো ভারী সাহসী আর বুদ্ধিমান ছেলে। চমকে উঠে কৃষ্ণ দেখল তার পেছনে ধুতি, ফতুয়া পরা একজন দাঁড়িয়ে আছে। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। বয়স আন্দাজ ওই রূপমদাদার মত কুড়ি-একুশ।

-----আপনি কে? এখানে কী করছেন? অবাক গলায় প্রশ্ন করল কৃষ্ণ।

-----যাব্বাবা। এতগুলো অঙ্ক কষে দিলুম তোমার আর জিগ্যেস করছ আমি কে!

-----আপনি কষে দিলেন!

-----তা নয়ত কি ওই হায়ার ম্যাথমেটিক্স তুমি কষে ফেললে?

কৃষ্ণ রাগী গলায় বলল, “ আমি যে অঙ্কগুলো করিনি আমিও জানি কিন্তু আপনি করেছেন জানব কী করে?

----তা অবশ্য ঠিক। তুমি বুঝবে কী করে? যাই হোক যা বলছিলুম, তুমি খাসা ছেলে। বদমাশ সাহেবটাকে তাড়িয়ে ছাড়লে। আমি যদি তোমার মত সাহসী হতুম তাহলে আর বেঘোরে প্রাণটা যেত না।

----মানে?

------আরে বাবা আমি যে ভূত সেটা কি এখনও বুঝতে পারোনি?

-----তা কেন পারব না? এই জঙ্গলটা যে ভূতদের আড্ডাখানা সেইটা বুঝতে কি আমার বাকি আছে? কিন্তু আপনার হিস্ট্রিটা কী সেটা জানতে চাইছি।

-----ও তাই বলো। শোনো তাহলে। সে অনেক দিন আগের কথা। স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্র ছিলুম। অঙ্ক নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তুম। আমার এক দিদির বিয়ে হয়েছিল সুন্দরগড়ে। ছুটিতে দিদির বাড়ি বেড়াতে এসেছিলুম। আমার মধ্যে একটু কবি কবি ভাবও ছিল। একদিন বিকেলে আপন মনে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে এই জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি খেয়াল নেই। এদিকে সূর্যও ডুবে গেল। আর এই জঙ্গলের দুর্নাম সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানাও ছিল না। টুকটাক শুনেছিলাম কিন্তু বিশ্বাস করিনি। বিশ্বাস হলো যখন সাহেবের ভূতকে নিজের চোখে দেখলুম। তোমার মত সাহস ছিল না তাই সহজেই সাহেব আমাকে…...।

কৃষ্ণ এই প্রথম ভূতকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখল।

-----জানো, অনেক স্বপ্ন ছিল আমার। অনেক লেখাপড়া করব। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াব কিন্তু বেঘোরে প্রাণটা গিয়ে অতৃপ্ত আত্মা হয়ে এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। তবে সাহেব বাংলোর ধারে কাছে পারতপক্ষে আসতাম না। মরেও আমার মধ্যে থেকে ভয় যায়নি কিন্তু আজকে দূর থেকে তোমাকে আর সাহেবকে দেখে কৌতূহলী হয়ে এসে পড়েছিলুম। তোমাদের কথাবার্তা সব শুনলুম। এত বছর ভূত হয়ে থেকে ভূতেদের চোখ এড়ানোর উপায়টা ভালোই রপ্ত করেছি তাই সাহেবের চোখ এড়িয়ে পেনটার মধ্যে সুড়ুত করে ঢুকে গেলুম। পেনটাও তো আবার ভূতের পেন। সাহেবের চালাকিটা তো দেখলে! ক্লাস নাইনের ছেলেকে কেউ নিউমেরিক্যাল অ্যানালিসিস, শক্ত শক্ত ইন্টিগ্রেশন দেয়! নিশ্চিত ছিল তুমি পারবে না কিন্তু দিলুম তো সাহেবের চাল ভণ্ডুল করে।

-----থ্যাঙ্কস। আপনি না থাকলে তো আজ সাহেব আমাকেও….।

-----না না। আমি কিছু করিনি। তোমার সাহস আর বুদ্ধি ছিল বলেই আজ তুমি বেঁচে আছ।

-----আচ্ছা, আপনার নাম কী সেটাই তো এখনও জানা হলো না।

-----প্রাণকৃষ্ণ পাত্র।

কৃষ্ণ ভ্রু কুঁচকে বলল, “ আপনার সেই দিদির নাম কি কুসুম?”

----হ্যাঁ, তুমি জানলে কী করে? উত্তেজিত হয়ে ওঠে প্রাণকৃষ্ণ।

-----তিনি যে আমার বড় ঠাকুমা। বাবার জ্যাঠাইমা। আজও আপনার কথা মনে করে চোখের জল মোছেন তিনি। বড় ঠাকুমার কাছে আপনার কথা তো শুনেছি আমি। আপনি তো খুব ভালো ছিলেন পড়াশোনায়।

----তুমি আমার কুসুম দিদির নাতি হও। কুসুম দিদি আজও আমার কথা মনে করে!

ভূতের চোখে জল আসে না, নইলে প্রাণকৃষ্ণর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসতো। একটু থেমে প্রাণকৃষ্ণ বলল, “ সাহেবের ভূত এই জঙ্গল ছেড়ে চলে যেতেই আমারও মুক্তি হয়ে গেল। কুসুম দিদিকে বোলো আর যেন না কাঁদে।”

কৃষ্ণ অবাক হয়ে দেখল প্রাণকৃষ্ণ একটা উজ্জ্বল আলোর কুন্ডলী হয়ে আকাশের বুকে মিলিয়ে গেল।



“ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ।” একসঙ্গে অনেক লোকের ডাকাডাকির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল কৃষ্ণর। প্রাণকৃষ্ণ চলে যাবার পর একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে কুঁকড়ে বসেছিল সে। রাত্রিবেলা জঙ্গল থেকে বেরোতে পারবে না বুঝতেই পেরেছিল। কখন ঘুম ধরে গেছে বুঝতেই পারেনি। গতকাল সন্ধ্যে গড়িয়ে যাবার পরও কৃষ্ণ বাড়ি না ফেরায় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। কোথাও খোঁজ না পাওয়ায় শেষে থানায় খবর দেওয়া হয়। দারোগবাবু কৃষ্ণর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার পর তাঁর সন্দেহ হওয়ায় পল্টুকে চেপে ধরেন। পুলিশের ভয়ে পল্টু সমস্ত স্বীকার করে ফেলে যে বিকেল বেলা কৃষ্ণর মাথায় আঘাত করে তাকে অজ্ঞান করে তারা সাহেব বাড়ির জঙ্গলে ফেলে আসে। পকেটে করে ঠাকুরের ছবি নিয়ে তারা জঙ্গলে ঢুকেছিল। কৃষ্ণর ক্ষতি করার জন্যই তারা এমন দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলেছে। একথা জানার পরই দিনের আলো ফুটতেই সবাই কৃষ্ণর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে অবশ্য বেশিরভাগ জনেরই ধারণা কৃষ্ণকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

মানুষের গলার আওয়াজ অনুসরণ করে ছুটে গেল কৃষ্ণ।



বাড়ি ফিরে সবার আদর আর সেই সাথে কৃষ্ণর প্রিয় গুড় পিঠে খেতে খেতে কৃষ্ণ ভাবলো লুকিয়ে লুকিয়ে বড় ঠাকুমাকে তার ভাইয়ের খবরটা দিতে হবে। মানুষটা আজও ভাইয়ের কথা মনে করে বড় কষ্ট পায়।



অলঙ্করণ : আবির

No comments:

Post a Comment