গল্পের ঝুলি : শীতের দেশের গল্প : অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়




শীত বড় আরামের, বড় আদরের। এই সময়ে মন ভাল করে দেওয়া কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব দেখা যায় আকাশে বাতাসে। শীত এসে গেল তো - চলো চলি চড়ুইভাতিতে। নিদেনপক্ষে মিঠে রোদে পিঠ মেলে ধরে খাও বাদামভাজা। কিম্বা নেমে পড়ো মাঠে ব্যাট বল নিয়ে।

সারাবছর সবাই অপেক্ষা করে থাকে, শীত পড়লে বেড়াতে যাবে ট্রেনে চড়ে দার্জিলিং, কালিম্পং বা আর একটু দূরে সিমলা বা কুলু-

মানালি। শীত নিয়ে আমাদের এই যে বাড়াবাড়ি, সে কিন্তু আমাদের দেশ গ্রীষ্মপ্রধান বলে। বড় বিচিত্র আমাদের এই দেশ। গ্রীষ্মপ্রধান হলেও ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল শীতকালে তুষারাবৃত হয়ে যায়। যেমন কাশ্মীর বা হিমাচল প্রদেশ। সেখানে আছে হিমালয় পাহাড়। আবার সমুদ্রের কাছাকাছি শীতের তীব্রতা অতটা থাকে না। আমরা যারা সমতলে বা সমুদ্রের কাছাকাছি থাকি, তারা বছরের শীতের দুই মাসের আগমনের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকি।

কিন্তু বিশ্বের সর্বত্র তো আর ভারতের মতো নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া নেই! যেমন পৃথিবীর উত্তর আর দক্ষিণমেরুর কাছাকাছি অঞ্চল বছরের বেশির ভাগ সময় বরফের পুরু চাদরে ঢাকা থাকে। যারা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বাস করে তাদের পক্ষে মেরু অঞ্চলের শীতের প্রবলতা ধারণায় আনা একটু অসুবিধের। সেখানে শীতকালে আবহাওয়ার তাপমাত্রা শূন্যাঙ্কের অনেক নিচে নেমে যায়। প্রবল তুষারপাতের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে হাওয়ার দাপট। মেরু অঞ্চলে বছরের ছ'মাস থাকে শীত আর বাকি ছ'মাস গ্রীষ্ম। গ্রীষ্মকালেও তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করে। আবার শীতকাল মানেই এখানে সারাদিন থাকে অন্ধকার। তাই মানুষ বাড়ি ছেড়ে বেরোতেও পারে না। উত্তরমেরুর বাসিন্দারা শীতকালের জন্য সিল মাছ, শ্বেত ভল্লুক, সিন্ধুঘোটক শিকার করে তাদের মাংস জমিয়ে রাখে।

আর শীতকালে কাজ না থাকলে মানুষগুলো কী করে? অবশ্যই গল্পগুজব করে সময় কাটায়। তখন তো আর ওদের দেশের বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার বালাই থাকে না। বেচারারা যে চড়ুইভাতি করতে যাবে, তারই বা উপায় কী! চারিদিক বরফের কয়েক মিটার পুরু আস্তরণে ঢাকা পড়ে যায়। সেই প্রচণ্ড শীতকালটা মেরু অঞ্চলের মানুষদের পক্ষে খুব কষ্টের। সিল মাছ আর ভল্লুকের চামড়া দিয়ে জ্যাকেট বানিয়ে তারা ঠাণ্ডা থেকে নিজেদের বাঁচায়।

বরফে ঢাকা পড়ে যাওয়া এইসব এলাকায় মানুষের মুখে মুখে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প ছড়িয়ে আছে। শতকের পর শতক ধরে বরফাবৃত অঞ্চলে দাদু দিদা, বাবা মায়েরা মুখে মুখে তাদের বাচ্চাদের গল্প শুনিয়ে হয়তো বাচ্চাদের ভুলিয়ে রাখে বা ঘুম পাড়ায়। আমেরিকার আলাস্কায় উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত এমনি এক গল্প আজ তোমাদের শোনাব।


***

এই জগতে আপন বলতে জো-এর কেউ ছিল না, সে ছিল এক অনাথ বালক। তার বাবা-মা, ভাই বোন ছিল না বলে তার নিজের কোনও ঘরও ছিল না। পাহাড়ের নিচে এক গ্রামে ছোট্ট জো বেঁচে থাকার জন্য এর ওর বাড়ি চেয়েচিন্তে, খাবার জুটিয়ে, কোনোরকমে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখত। গ্রামের লোকেরা তাকে থাকতে দিয়েছিল ফসলের এক গুদামে।

​খাবারদাবার জোকে কেউ এমনি এমনি দিত না। হাতের কাছে ওকে দেখতে পেলেই খুব একচোট খাটিয়ে নিত। কেউ বলত, ‘নদী থেকে চার বালতি জল তুলে আন দেখি।’ কেউ বলত, ‘এই জো, জঙ্গল থেকে ক’টা কাঠ কেটে নিয়ে আয় না!’ আবার কেউ বলত, ‘যা এই ছাগলগুলো চরিয়ে আন পাহাড়ের নিচে ঘাসের জমিতে। ফিরে এসে সন্ধেবেলা দুটো রুটি আর মাংসের ঝোল নিয়ে যাস।‘

​জো তার খিদের জ্বালা ভুলে, দুটো মাংসের টুকরো সমেত একবাটি ঝোলের লোভে পাহাড়ের নিচে ঘাসের বিস্তীর্ণ সবুজ জমিতে ছাগলের পাল নিয়ে ছুটত। সকালের খাবার পেটের মধ্যে হজম হয়ে যেতে বেশি সময় লাগত না। ছাগলের পাল যখন ঘাস খেতে ব্যস্ত থাকত, তখন জো-এর পেট খিদের আগুনে দাউদাউ করে জ্বলত - ঠিক যেমন দূরে পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলে আগুন লেগে যায় হঠাৎ হঠাৎ।

​পেটের খিদে বড় বালাই! তাই জঙ্গলের বুনো ফল খেয়ে, ঝর্ণার জলে পেট ভরাত জো। ছাগলের পাল ফিরিয়ে গ্রামে নিয়ে এলে মালিক তাকে দুটোর বদলে একটা রুটি ছুঁড়ে দিত। মাংসের টুকরোর জায়গায় হাড় জুটত কপালে। সেই সব নিয়ে অবশ্য জো-এর কোনও অভিযোগ ছিল না, কারণ সে ছিল এক অত্যন্ত সরল মনের মানুষ। আর দুঃখ হলে কাকেই বা সে সেকথা সে জানাতে পারত? তার নিজের লোক কেউ ছিল না যে! যা পেত, তাই খেয়ে পেট ভরিয়ে, ফসলের গুদামঘরে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ত জো।

​এই ভাবেই গ্রামের মানুষের ফাইফরমাশ খেটে দিন গুজরান হচ্ছিল ছোট্ট জো-এর। দুটো খাবার জুটিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই ছিল তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। একদিন ফসলের গুদামঘরে গ্রামের একদল চাষি ফসল জমা করে বসে বসে গল্প গুজব করছিল। ঠিক সেই সময়ে শুরু হল প্রবল ঝড়। ঝড়ের সাথে বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে সাথে বরফ পড়তে শুরু করল। তীব্র শীতে ঘরের মধ্যে জড়ো হয়ে ওঠা মানুষেরা বাড়ি ফিরতে না পেরে ঘরের মধ্যে খড় জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব চালাতে লাগল। ছোট্ট জো ঘরের এককোণে ভল্লুকের চামড়া দিয়ে তৈরি ছেঁড়া একটা কম্বল জড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল।

​চাষির দলের মধ্যে মুরুব্বি গোছের লোকটা জোকে ডেকে বলল, “যা, বাইরে গিয়ে দেখে আয় বরফ পড়া কমে গেছে কিনা।”

​জবরদস্ত ঠাণ্ডায় বিপর্যস্ত জো বাইরে যাওয়ার জন্য গড়িমসি করছে দেখে একজন লাঠি দিয়ে জোকে খুঁচিয়ে দেয়। তাড়া খাওয়া পশুর মতো দরজা খুলে বাইরে আসে জো। ঘুরে এসে জো বলে, “বৃষ্টি একটু কমে গেছে। তবে হাওয়া বইছে শনশন করে।”

​এইভাবেই আগুনের তাপ নিতে নিতে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে চাষবাস আর লাভ-ক্ষতি নিয়ে গল্প করতে থাকে, আর মাঝে মধ্যেই জোকে বাইরে পাঠাতে থাকে আবহাওয়ার খবর নিতে। ক্লান্ত শরীরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে জো এক একবার কম্বলের তলায় নিজেকে মারাত্মক ঠাণ্ডা থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে, আর এক একবার লোকগুলোর হুকুমে বাইরে গিয়ে দেখতে থাকে বরফ পড়া কমেছে কি না। এইভাবেই রাত গভীর হতে থাকে। ঘুমন্ত জোকে আবার একটা ষণ্ডা লোক খুঁচিয়ে তুলে বাইরে পাঠায়। ফিরে এসে উত্তেজিত গলায় জো বলে, “পাহাড়ের দিকে একটা লাল আগুনের গোলা দেখতে পেলাম। সেটা আবার এদিকেই এগিয়ে আসছে দেখছি।”

​লোকগুলো হো হো করে হেসে ওঠে। দলপতি বলে, “ঠাণ্ডায় তোর বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়েছে। আবার গিয়ে দেখ দেখি, বোধহয় একটা বিশাল তিমিমাছ পাহাড় থেকে ছুটে আসছে তোকে গিলে ফেলবে বলে।”

​লোকটার রসিকতা ছোট্ট জো বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর আগুনের শিখার সামনে চাষির দল দুলে দুলে হাসতে থাকে। ঠিক তখনি বাইরের দরজার ফাঁক দিয়ে লাল আলো দেখা যায়। গুদামের ছাতের ফুটো দিয়ে সেই আলোর ফুলকি নাচতে নাচতে ঘরের ভিতর ধীরে ধীরে নামতে থাকে। লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কথা থামিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে ভয়ে ঘরের এক কোণায় জড়ো হয়ে যায়। আলোর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে মানুষের এক কঙ্কাল। ঘরের দরজা সজোরে খুলে যায়। ঝড়ো হাওয়াও ভয়ে ঘরের চৌকাঠ পেরতে পারে না। কঙ্কালের ইশারায় দুষ্টু লোকগুলো দুর্বার টানে তার পিছু নেয়। কঙ্কাল নাচতে নাচতে চলে পাহাড়ের দিকে। লোকগুলোও সে টেনে নিয়ে যায়। চিৎকার করতে থাকা লোকগুলো একসময়ে পাহাড়ের দিকে হারিয়ে যায়।

​পরদিন সকালে লোকগুলোর মৃতদেহ পাওয়া যায় পাহাড়ের নিচে ঘাসের জমিতে। গ্রামবাসীরা উদ্ধার করে জো-এর বাবার কবর, বহুদিন আগে তাকে মেরে চাষিরা মাটির তলায় সেখানে পুঁতে রেখেছিল।

(সমাপ্ত )

অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

No comments:

Post a Comment