বই কথা কওঃ চার্লস ডিকেন্সের 'আ ক্রিসমাস ক্যারল' : দেবলীনা দাস



এখন আমি বুড়ি থুত্থুড়ি, শনের নুড়ি চুল। কিন্তু চার্লস ডিকেন্সের ‘'আ ক্রিসমাস ক্যারল’ বইটির সঙ্গে যখন আমার পরিচয় ঘটে, তখন আমার বয়স কিন্তু তোমাদের থেকে খুব বেশি ছিল না। ক্লাস নাইন না টেন মনে পড়ে না ঠিক, তবে সিবিএসই র ইংলিশ রিডারে 'আ ক্রিসমাস ক্যারল’ এর একটি সংক্ষিপ্ত নাট্যরূপ ছিল। বড়দিন আসি-আসি করছে, এমন সময়ে কিশলয়ের শীত সংখ্যায় বইবকবক লিখতে বসে তারই কথা মনে পড়ল।
ডিকেন্স শুনেই ভয় পেয়ে যেও না। ভিক্টোরিয়ান এই সাহিত্যিকের বাকি উপন্যাসগুলোর মত বিশাল কলেবর নয় ‘আ ক্রিসমাস ক্যারল’ এর। এই মুহূর্তে আমার নাগালের মধ্যে আছে প্রজেক্ট গুটেনবার্গের ইবুকটি, আর তাতে ৭৮টি মাত্র পৃষ্ঠা। উপন্যাসিকা বা নভেলা বলা হয় একে। বিষয়বস্তুও সহজসরল, এমন কি চাইলে ভূতের গল্প মনে করেও পড়া যেতে পারে।
বইয়ের শুরুতেই আমাদের আলাপ হয়ে যাবে মুখ্য চরিত্র স্ক্রুজের সাথে। নামটা চেনা লাগছে তো? লাগবেই। কারণ ডিজনির ‘ডাকটেলস’ খ্যাত ধনকুবের এবং কৃপণ শিরোমণি আঙ্কল স্ক্রুজের নামটি এখান থেকেই তো নেওয়া হয়েছে। ডিকেন্সের স্ক্রুজও কিনা ঝানু ব্যবসাদার, প্রচুর পয়সার মালিক, এবং কৃপণ। হুঁকোমুখো স্ক্রুজ কাউকে ভালোবাসে না, তার জীবনে কোথাও এক কণাও আনন্দ নেই, কোনো শখ নেই। দেদার পয়সা রোজগার করা এবং সে ধনকে দু'হাতে আগলানো - এছাড়া তার কোনো লক্ষ্য নেই জীবনে। আমাদের দুর্গাপূজার মত ক্রিশ্চানদের সম্বৎসরের সব চেয়ে বড় উৎসব, প্রাণের উৎসব যে ক্রিসমাস - সেই উৎসবকে নিয়ে মাতামাতি করাকে স্ক্রুজ মনে করে মূর্খামি, সময় নষ্ট করা। কিন্তু এরকমই এক ক্রিসমাসে তিন ভূত দেখা দেয় স্ক্রুজকে, তার গোটা জীবনটাই আমূল বদলে যায়।
এই ভূতদের ঠিক ভূত বলা যায় না। স্ক্রুজের পরলোকগত পার্টনার মার্লির মত মৃত মানুষের আত্মা নয় এরা। ঘোস্ট অফ ক্রিসমাস পাস্ট, ঘোস্ট অফ ক্রিসমাস প্রেজেন্ট আর ঘোস্ট অফ ক্রিসমাস ইয়েট টু কাম স্ক্রুজের হাত ধরে তাকে দেখিয়ে আনে তার গোটা জীবনখানা। দেখায় ধনার্জনের নেশায় মত্ত স্ক্রুজ কিভাবে আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের থেকে আলাদা হতে হতে একলা হয়ে গেল। দেখায় স্ক্রুজের কেরানি মিস্টার ক্র‍্যাচিটের বাড়ির ক্রিসমাস সেলিব্রেশন - কেমন করে দারিদ্র‍্যের মধ্যেও মানুষ পরিবারের ভালোবাসায় ভালো থাকে। অভাব যেন শীতের মত - রুক্ষ, রিক্ত - জীবনের টুকরো খুশিগুলো তাকে জড়িয়ে রাখে তালিমারা কাঁথার ওমে।
সব শেষে স্ক্রুজ দেখে নিজের ভবিষ্যতের ছবি। তার মৃত্যুতে দুঃখ পায় না কেউ, বরং সুদে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে হবে না বলে আনন্দ পায় এক গরিব দম্পতি। তার শেষকৃত্যে কোনো আত্মীয় বন্ধু আসে না, বিনি পয়সার মধ্যাহ্নভোজনের লোভে আসে কেবল সুবিধেবাদী ব্যবসাদাররা।
কবরের ওপরের ফলকে নিজের নাম পড়ে আঁতকে ওঠে স্ক্রুজ। ঘোস্টের কাছে কাকুতিমিনতি করে, একটা সুযোগের জন্য। ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি ‘আ সেকেন্ড চান্স’ - নিজের ভুলভ্রান্তি শুধরে নিয়ে জীবনকে নতুন ভাবে বাঁচার আরেকটা সুযোগ। স্ক্রুজ কি সেকেন্ড চান্স পায়? পেয়ে কাজে লাগাতে পারে সেই চান্সকে? ভবিতব্যকে পালটে ফেলতে পারে? জানতে চাইলে পড়ে ফেলো ‘'আ ক্রিসমাস ক্যারল’’।
‘ক্রিসমাস ক্যারল’ কেবল ক্রিসমাসের গল্প নয়। সব ধর্মের, সব দেশের আনন্দ উৎসবের গল্প। কারণ উৎসব মানেই তো মানুষে মানুষে মেলবন্ধন। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ড ছিল যেন এক দেশের মধ্যে দু'খানা আলাদা দেশ - ধনীদের ইংল্যান্ডে গরিবদের কোনো অধিকারই ছিল না, তাদের অন্ধকারকে ছুঁতে পারত না আনন্দের রোশনাই। ডিকেন্স এই দুই ইংল্যান্ডকেই মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন স্ক্রুজের গল্পের মধ্যে দিয়ে। বোঝাতে চেয়েছিলেন, আনন্দ কেবল স্বার্থপরের মত কুক্ষিগত করে রাখার জিনিস নয়, সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জিনিস। অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর মধ্যেই রয়েছে ‘দ্য স্পিরিট অফ ক্রিসমাস’।
বইটির দাম বেশি নয়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাবলিশিং এর এডিশনটির দাম একশো টাকা, ওয়ার্ডসওয়ার্থ চিল্ড্রেনস ক্লাসিকসের বইটির দাম আর পঁচিশ টাকা বেশি। ইলাস্ট্রেটেড বইও পাওয়া যায়।
তাহলে দেরি না করে এই শীতেই পড়ে ফেলো ‘আ ক্রিসমাস ক্যারল’। কেমন লাগল সে কথা কিশলয়কে চিঠি লিখে জানাতে ভুলো না যেন।

No comments:

Post a Comment