গল্পের ঝুলি : সার্কাস : সৌমি মল্লিক




ছোট্ট বিলুর খুব মনখারাপ। মিলি, টুবাই, বুমবুম সবারই দু'বার করে সার্কাস দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু বিলুকে ওর মা একবারও সার্কাস দেখতে নিয়ে যায়নি। স্কুলে টিফিনের সময় টুবাই কতো গল্প করলো সার্কাসের। একটা নাকি বাচ্চা হাতি এসেছে সার্কাসে! ওকে নাকি চিনেবাদাম ভাজা খেতে দিলে ভারি খুশি হয়ে শুঁড় নাড়ায়! বিলু সত্যিকারের হাতি কখনো দেখেনি, ড্রয়িং বুকে হাতির ছবি দেখেছে। সেদিন তো বিলুর আঁকার দিদিমণি কি বকাটাই না দিলো বিলুকে, হাতির শুঁড়টা ঠিকঠাক না আঁকতে পারার জন্য। তা শুঁড় আঁকতে পারেনি তো কী হয়েছে , বিলু কিন্তু হাতিকে খুব ভালোবাসে! ওর কতদিনের ইচ্ছে ওর একটা হাতি বন্ধু থাকবে, ওর সাথে ফুটবল খেলবে, ওকে পিঠে চাপিয়ে জঙ্গলে ঘুরতে নিয়ে যাবে ! কি মজা ! বিলুর ইচ্ছে করছে এখুনি গিয়ে সার্কাসের বাচ্চা হাতিটার সাথে আলাপ জমায় !

শুধু কি হাতি, বুমবুম বলছিল একটা ছোট্ট মেনি বাঁদরও আছে সার্কাসে ! বাঁদরটা নাকি সকলের দিকে চেয়ে চোখ পিটপিট করে! আগেরবারের গরমের ছুটিতে বিলুদের বাড়ির বাগানের আমগাছটায় দুটো বড়ো বড়ো বাঁদর এসেছিল।  কী সুন্দর বাদামী রঙ কিন্তু মুখটা কালো! দাদাই বিলুকে গল্প বলেছিল , সীতামাকে রাবণের লঙ্কা থেকে আনতে গিয়ে হনুমানের মুখ পুড়ে গিয়েছিল । সেই থেকে ওদের সবার মুখ পোড়া! বিলুর খুব কান্না পায়। আহারে! বেচারি হনুমানের কতই না কষ্ট হয়েছিল! বিলুর তো সেদিন চুপিচুপি দুধের কড়া থেকে সর তুলতে গিয়ে গরম দুধে আঙ্গুল পুড়ে গিয়েছিলো। কী জ্বালা করছিল বিলুর! তার ওপর ঠামার বকা , মায়ের বকা ! ভাগ্যিস দাদাই ঘরে ছিলো সেদিন তাইতো ঠামার ঠাকুরঘর থেকে ঘি নিয়ে বিলুর আঙ্গুলে লাগিয়ে দিয়েছিল।

বিলুদের আমগাছের হনুমান দুটো এক ঝাঁপে বিলুদের উঠোনটায় নেমেছিল। রাঙাপিসি ওদের চারটে করে মিল্কি বিস্কুট দিয়েছিল। ওরা মাটিতে পা ছড়িয়ে হাতে করে বিস্কুট খাচ্ছিল । সার্কাসের বাঁদরটা ওরকম কিনা কে জানে?

মলি তো বলছিল সার্কাসে জিরাফ, ঘোড়া, গলায় ঝুমঝুমি বাঁধা কুকুর, মুখে রঙ মাখা জোকার আরও কত কী আছে! বিলু জিরাফ টিভিতে দেখেছে। ইয়া লম্বা গলা, গায়ে হলুদ চাকা চাকা দাগ। একটা কত লম্বা গাছ থেকে গলা উঁচিয়ে পাতা খাচ্ছে। আর ঘোড়া তো সেবার দিঘা বেড়াতে গিয়ে দেখেছে বিলু। সাগরপাড়ে সাদা, কালো, বাদামি, লালচে কত রঙের ঘোড়া ! বিলু একটা কালো ঘোড়ার পিঠে চেপে ফটো তুলেছিল, ঘোড়াটার কেশরটা ছিল লালচে ।

আর রইলো বাকি কুকুর, তো বিলুদের পাড়ায় কতো কুকুর আছে ! লালু , ভুলু এই সব নাম। বিলু তো ওদের মাঝে মধ্যেই বিস্কুট খেতে দেয়। তবে বিলু মুখে রঙ মাখা জোকার কখনো দেখেনি। নাহ্, এবার বিলুকে সার্কাসে যেতেই হবে। বিলু ভাবে বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে খুব কাঁদবে সার্কাসে যাবার জন্য। এরপরও যদি না নিয়ে যায় তবে বিলু বিকেলে আর দুধ খাবে না।

বিলু বাড়িতে গিয়ে কান্না জোড়ে, ওকে সার্কাসে নিয়ে যেতে হবেই। মা - ঠামা গোলগোল চোখ করে তাকায় বিলুর দিকে। বিলু ভয় পেয়ে চুপ করে যায়।

রাতে বিলু অঙ্কে ভুল করে। মা আচ্ছাসে বিলুর চুলের ঝুঁটি নাড়িয়ে দেয়। বিলুর চোখে জল টলমল করে , তবু বিলু কাঁদে না। দাদাই বলেছিলো কাঁদলে হুতুম পেঁচা এসে পিঠে করে ওদের দেশে নিয়ে চলে যায়, আর কোনোদিন বাড়ি ফেরা যাবে না।

রাতে বিলু বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে ওকে কেউ ভালোবাসে না, এক দাদাই ছাড়া। দাদাই থাকলে ওকে ঠিক সার্কাস দেখাতে নিয়ে যেতো। কিন্তু দাদাই তো পিপির বাড়ি গেছে! দাদাই যখন ফিরবে তখন তো সার্কাস শেষ।

বিলু ভাবে ও হাতি হয়ে যাবে , সার্কাসে শুঁড় নাড়িয়ে খেলা দেখাবে। নয়তো হনুমান হয়ে গাছ থেকে আম পেড়ে খাবে , ইচ্ছে মতো ঝাঁপাবে। মা একটুও বকতে পারবে না। ওর থেকে তো জিরাফটা কতো খুশি। ছবি আঁকতে হয় না , অঙ্ক করতে হয় না, মনের খুশিতে লম্বা গলা উঁচিয়ে পাতা পেড়ে খায়।

অনেক রাত্রে ঘুম ভাঙে বিলুর। একি, কোথায় এসেছে বিলু! বিলুর পেছন দিকে লাল পাড় জরির ইয়া বড়ো একটা পর্দা , চারপাশে কতো আলো! আরে ওই তো সেই জোকারগুলো মুখে রঙ মেখে বিলুর দিকে তাকিয়ে হাসছে। কতো রকমের ভঙ্গি করে ডিগবাজি খেলো ওরা। বিলু তো হেসেই অস্থির!

আরে ওই লোকটা অতো উঁচু থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে কেন? ও পড়ে গেলে কি ওর মা বকবে না নাকি? আরে বেশ তো কায়দা করে ওপর থেকে নিচে খাটানো জালের মধ্যে এসে পড়লো লোকটা! ওই তো হাতিটা শুঁড় দিয়ে একটা ইয়া বড়ো রিংকে ঘোরাচ্ছে। জিরাফটাও কী সুন্দর খেলা দেখাচ্ছে! কুকুরটা কেমন ওই রিংটার ভেতর দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে যাচ্ছে। আরে রিংটার চারপাশে তো আগুন জ্বলছে! বিলু তো বলেই ফেললো , "দেখে ঝাঁপাও নয়তো পুড়ে যাবে!"

হাতিটা কী সুন্দর ফুটবল খেলছে কুকুরগুলোর সাথে! বাঁদরটা কতো সুন্দর নেচে দেখালো। উফঃ আরও কতো রকমের খেলা!

খেলা শেষে হাতিটা এগিয়ে এলো বিলুর কাছে। বিলুর দিকে চেয়ে বললো,
"আমার নাম মধু! তোমার নাম তো বিলু? আমি জানি। তুমি খুব মিষ্টি!"

বিলু তো হাতির কথা শুনে অবাক হয়ে গেছে।হাতি কথা বলতে পারে! শুনে তো বিলু অবাক ! এই কথাটাই হাতিকে জিগেস করতে হাতি বললো,

"খুব পারে! আমরা সব হাতিরাই কথা বলতে পারি তবে সব মানুষরা আমাদের কথা বুঝতে পারে না। শুধু যারা আমাদের ভালোবাসে তারাই আমাদের কথা শুনতে পারে, আমাদের ভাষা বুঝতে পারে ! তুমি তো আমাদের খুব ভালোবাসো তাই তুমি আমার কথা শুনতে পারছো! "


বিলু ভারী খুশি হয় । বিলু হাতিকে ওর স্কুলের গল্প বলে , ওর মায়ের তৈরি পায়েসের কথা বলে আরও কতো গল্প করে হাতির সাথে ! সেই সাথে এটাও বলে বিলুকে নাকি ওর বাড়ির কেউ ভালোবাসে না তাই ও সার্কাসে খেলা দেখাতে চলে আসবে!

হাতিও বলে ওর জঙ্গলের কথা , কীভাবে ও ফাঁদে পড়ে এখানে আসে জঙ্গল ছেড়ে , ওর বাবা - মা কে ছেড়ে সেই গল্প ! এখানে নাকি ঠিক করে না খেলা দেখালে ওকে রিং মাষ্টার চাবুক দিয়ে মারে! ও পিছন ঘুরে ওর পিঠের চাবুকের দাগ গুলো দেখালো। আগে নাকি ওর মা ওকে খুব বকতো কিন্তু এখানে আসার পর থেকেই ওর মায়ের জন্য খুব মন কেমন করে।

বিলুর মন খারাপ হয়ে যায় । সত্যি তো বিলুকে ওর মা অঙ্ক না পারলে চুলের ঝুঁটি নাড়িয়ে দেয় ঠিকই কিন্তু সেইবার বিলুর জ্বরের সময় মা বিলুর পছন্দ মতো সুজির পোলাও করে দিয়েছিল। আবার বসন্ত মেলায় বেলুনও কিনে দিয়েছিল।

জিরাফটা এসে বললো ওকে নাকি ওর ছোট্ট ছেলেটাকে ফেলে এখানে আসতে হয়েছে শিকারিদের ফাঁদে পড়ে ! ওর ছেলের জন্য ভীষণ মন কেমন করে। ওর ছেলেটা তো ওর কোলে না ঘেঁষে শুতেই পারে না।

বিলুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ওর মা তো বিলুকে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারে না। বিলুরও তো রাত্রে মায়ের কোল ঘেঁষে না ঘুমোলে ঘুম আসতেই চায় না।

জোকাররাও বললো ওদেরও বাড়ি যেতে খুব ইচ্ছে করে । যাতে ওদের চোখের জল কেউ না দেখতে পায় তাই ওরা সব সময় মুখে রঙ মেখে থাকে ।

ঘোড়ারাও বললো ওদেরও ভীষণ মন খারাপ করে। পাহাড়ের সরু গিরিপথ দিয়ে ওদের ছুটতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখানে তো ওদের পায়ে শিকল পরানো থাকে।

বাঁদর এসে বলে ও আর ইচ্ছেমতো ঝাঁপাতে পারে না, গাছেও উঠতে পারে না, আম পেড়েও খেতে পারে না।

সব শুনে বিলুর মন খুুব খারাপ হয়ে যায়। না বাবা সার্কাসে খেলা দেখানোর কোনো ইচ্ছে আর নেই বিলুর। ওর বাড়ি , স্কুল , মা , ঠাম্মাই ভালো।

এমন সময় সেখানে রিং মাস্টার এসে হাজির। বিলুর দিকে চেয়ে বলে,

"এই ছেলে, তুমি না সার্কাসে খেলা দেখাতে চাও! আজ থেকে তুমি এখানে থেকেই খেলা দেখাবে এদের সঙ্গে। তোমায় আর কোনোদিন বাড়ি যেতে হবে না। মায়ের কাছে অঙ্ক করতে বসতে হবে না আর হাতির ছবিও আঁকতে হবে না।"

বিলু ভয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেছে ।

"না আমি সার্কাসে খেলা দেখাতে চাই না আর আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। আমি মাকে অনেকক্ষণ দেখিনি মায়ের কাছে যেতে চাই!" কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে বিলু।


" আরে এই বাবু কী বকছিস ঘুমের ঘোরে? ওঠ দেরি হয়ে যাবে তো স্কুল যেতে।" 

মায়ের ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙে যায় বিলুর। দু'হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বিলু !

"উফঃ কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম! ভাগ্যিস ওটা স্বপ্ন ছিলো!" মনে মনে ভাবে বিলু ।

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ,
" মা তুমি খুব ভালো। ঠামাও ভালো। আমি আর তোমাদের ওপর একটুও রাগ করবো না। আর আমি একটাও বায়না করবো না। জানো তো মা আমি বড়ো হয়ে সার্কাসের সব হাতি, ঘোড়া, কুকুর, বাঁদর, জিরাফ, জোকার সবাইকে মুক্ত করে দেবো। ওরা ওদের বাড়ি চলে যাবে। ওদেরও তো বাড়ির জন্যে , মায়ের জন্যে মন কেমন করে, তাই না মা?" 


মা খালি মিষ্টি হেসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয়।


~~ সমাপ্ত ~~


অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

No comments:

Post a Comment