স্মৃতিকথা : লোডশেডিং : মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস




লোডশেডিং মানে তো শুধু রাত নয়, দিনও কিন্তু আমার লোডশেডিং বললেই অন্ধকারই মনে হয়৷ আকাশের রঙ চেনানোর জন্য লোডশেডিংকে এখন খুব দরকারি মনে হয়, যে লোডশেডিংএ কোথাও জেনারেটার, ইনভার্টার উৎপাত করে না মিশমিশে কালোর ওপর জ্বলে ওঠা ঝিকমিক তারাদের৷ গরমের রাত হলে তো কথাই নেই৷ বাড়ির সবাই চল ছুটি ছাতে৷ এভাবেই অন্ধকারে কত তারা চিনতাম৷ কত গল্প ধাঁধা অচেনা কথা ভাগাভাগি হত বাড়ির সবার সঙ্গে৷ এই লোডশেডিং যেন এক 'গেট টুগেদার'এর হাতছানি, বিশেষত তা যদি হত সন্ধে বা আরও পরে৷


মনে পড়ছে হ্যারিকেন, ল্যাম্প এসব ভুলে যাওয়া সঙ্গীদের৷ মায়েদের বাড়তি কাজ ছিল বিকেলের মধ্যে ছাই ঘষে কাচ মুছে তেল ভরে তৈরি রাখা তাদের৷ বড় ছেলে মেয়েদের জুটত সে ভার মাঝে মধ্যে৷ 

লোডশেডিং আর ভূতের ভয় অবিচ্ছেদ্দ্য৷ আমার মনে পড়ছে পড়তে বসার গল্প৷ থ্রি ফোরে পড়ি৷ দোতলার ঘরে একা আছি৷ বড়ঘরে মেঝেতে বসেছি পড়তে৷ দুদিকে দুই দরজা৷ মুখে আওড়াচ্ছি বইএর লাইন৷ এক বার নজর দিচ্ছি পেছনের দরজায় ৷ একবার সামনেরটাতে৷ ভূত তো আর বলে কয়ে আসবে না! যদি সুড়সুড়ি দেয় ভাল! যদি কামড়ে দেয়! সঙ্গে বাড়তি বদমাইশি৷ মশা ধরে তাকে বিকলাঙ্গ করে ফেলছি ল্যাম্পের ভেতর৷ কত নিষ্ঠুরতা!

আর একটু বড় হলে নিজের ভয় চেপে দিদিগিরি দেখাতে শিখলাম৷ ভাই বেশ ছোট৷ দু ভাই বোন ঘরে আছি৷ ঝপ করে আলো নিভে গেলে টপ করে হাতড়ে টর্চ হাতে নিয়ে থুতনির কাছে ধরে বোতাম টিপতাম৷ আয়নায় দেখেছিলাম বেশ ভয়জনক মুখ৷ ফলে ছোট্ট ভাইএর বিকট আর্তস্বর৷ বড়দের আগমন৷ আমার পিঠে দমাদম তাল৷ তবু বদমাইশি ছাড়তাম না৷

মেদিনীপুরে সেন্ট্রাল জেলে দাদু কর্মরত ছিলেন৷ সেখানে জেল কোয়াটার্সে মামাবাড়ি ছিল মাঠের মাঝে৷ এক পাশে জেলের সুউচ্চ প্রাচীর আর এক পাশে একটা ভাঙাচোরা বেওয়ারিশ বাড়ি ছিল পুকুর ধারে বটগাছের নিচে৷ ততদিনে ড্রাকুলার গল্প শোনা হয়ে গেছে মাসির কাছে৷ মনে হত আলো নিভলেই ওখান থেকে উড়ে আসবে ভাম্পায়ার৷ বাপরে বাপ! 

মনে পড়ছে বড় বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে ছুটির সন্ধেবেলায় বাবা কাকাদের ক্যারাম খেলা৷
একবার ভরা গরমে শহরে হাই টেনশন তার লাগানো হল৷ টানা ক'দিনের সেই লোডশেডিংএর কথা আজও মনে আছে৷ মা বাবা হাতপাখা নেড়ে ক্লান্ত৷ ছোটদের মধ্যে বেশ উৎসাহ —কাদের বাড়ির সামনে কাজ চলছে তার আলোচনা হত স্কুলে৷

আর মনে আসছে অনেক সন্ধ্যার মত এক সন্ধ্যার কথা৷ হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে পড়ছি৷ ইতিহাসের বই-এ তাজমহলের ছবির তলায় লেখা 'কালের কপোতলে শুভ্র সমুজ্বল'৷ দাদু চৌকিতে বসে৷ বড় ডাক্তার৷ বয়সের ভারে অবসরে৷ রবীন্দ্রনাথ আর রেডিও তাঁর নিত্য সঙ্গী৷ ওঁর ঘরে বসে পড়ছি, তাই বন্ধ রেডিও৷ তিল তেলের গন্ধ ভাসছে ঘরে৷ খাতা খুলতে বলে শ্রুতিলিপি নিতে বললেন৷ "................যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি তাহার খানিক মাগি আমি নত শিরে এত বলি নদী নীরে ফেলিল মাণিক"৷ দাদু চলে যাবার পর শুধু লাইনগুলো খুঁজবো বলে হাতড়ে ছিলাম ওঁর বইপত্র৷ একেই বোধ হয় মাণিক বলে৷

এবার একটু মজার স্মৃতি৷ মামারবাড়ির দাদুর কাছে বায়না করে কিনেছি এগরোল৷ বয়স্ক মানুষ এসবে অভ্যস্ত নয়৷ তখনকার দিনে এ খাবার সর্বত্র সুলভও নয়৷ দুজন খেতে হাঁটছি৷ ঝুপ ৷ আলো নেই৷ হাঁটছি তবু৷ দাদু হঠাৎ বলল "কী বাজে কাগজ কাগজটা!" 
"হো হো হো! করছো কী! কাগজও খেলে?" 
"আমি কী জানি!"দাদুর উত্তর৷ 
সৌজন্য লোডশেডিং৷

তবে বড় হবার সাথে সাথে হারিয়ে গেছে কষ্টকর লোডশেডিংরা৷ রাতের ঘুম কাড়া, রবিবারের টিভি কাড়া লোডশেডিংরা আজ লুপ্তপ্রায়৷ আজ যদি কোথাও বেড়াতে গিয়ে লোডশেডিংএর কবলে পড়ে ফোনটা চার্জ না করতে পারি তখন যে দুঃখ পাই, ছেলেবেলার রাতঘুম কাড়া লোডশেডিং আমাদের ততটা বিপদে ও দুঃখসাগরে ফেলতে পারত না এ আমি হলফ করে বলতে পারি৷


1 comment: