গল্পের ঝুলি : সুড়ঙ্গ : মধুমিতা সেনগুপ্ত




বাবার কথা শুনে খাওয়া শেষ না করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় ঋষি । প্রীতম ছেলের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাওয়া দেখে নিজের মা প্রীতির দিকে তাকান ।
ঋষির মা রোমিলা বলেন –“খেয়ে উঠে বলতে পারতে কথাটা । প্রতিবার বেড়াতে যাওয়ার সময় তোমার কোনো না কোনো ইম্পরট্যান্ট মিটিং পড়ে । ব্যাগ পর্যন্ত গুছিয়ে রেডি আমরা ..ধুর ভাল্লাগে না । মা আপনি সামলান আপনার নাতিকে । "


রাতে ঠাম্মা আর ঋষি একঘরে ঘুমায় । ছোটবেলার অভ্যাস । সবাই বারণ করলেও জেগে থাকেন ঠাম্মা যতক্ষণ না ঋষির পড়া শেষ হয় । বাবার চাকরি আর মায়ের বুটিক । দুজনের সব সময় ব্যস্ততা। ঠাম্মাই সবদিক সামলে নেন ঋষির ।


ঠাম্মা একহাতে থালায় দুজনের ভাগের রুটি আর বাটিতে মিক্স ভেজ নিয়ে ঋষির পাশে এসে বসেন।


“ আমার ক্ষিদে নেই । ” মোবাইলে খেলতে খেলতে জানিয়ে দেয় ঋষি ।

“ খাওয়ার উপর রাগ করতে নেই সোনা । বহুবার বলেছি । তুই না খেলে তোর মা খাবে না । আমিও খাবো না । আমার আবার সময়ে না খেলে শরীর অস্থির করে । সুগারটা মাপাতে হবে । হয়ত একদিন না খেয়ে সুগার ফল করে মরে যাবো ..।” বলতে থাকেন ঠাম্মা ।

নিশানা নির্ভুল ।

"দাও দাও খাচ্ছি । সবসময় তুমি এসব বলবে না তো । তোমার জন্য আমি ঠিকঠাক রাগটাও করতে পারি না । দাও খাইয়ে দাও।" ঋষি হাঁ করে।

ঠাম্মা পড়ার টেবিলের একপাশে প্লেটটা রেখে বাঁ হাতে ফোনটা নিয়ে রোমিলাকে টেক্সট করে খেয়ে নিতে বলেন । ফোনটা ঋষির হাতে ফেরৎ দিয়ে রুটি ছিঁড়ে বেশি করে তরকারি দিয়ে নাতির মুখে পুরে দেন ।

“ তুমি জানো আমি সবাইকে বলেছি এবার উইন্টারে আমরা মালয়েশিয়া হংকং যাচ্ছি । হেন করবো তেন করবো সব প্ল্যান বলেছি । এবার আমি মুখ দেখাবো কী করে? ঋতমরা কেরালা যাচ্ছে শ্রীরা রাজস্থান । শুধু আমি ঘরে বসে ছুটি কাটাবো ।” ঋষির চোখে জল আসবো আসবো করে ।

“কোথাও তো আমরা যাবোই । সেটা বিদেশ না হতে পারে ভিনরাজ্য না হতে পারে কিন্তু আমরা দুজনে বেড়াতে যাবো । বন্ধুদের বলবি ফরেন ট্রিপ ক্যান্সেল হয়ে আমরা প্রকৃতি পাঠ করতে যাবো । নেচার স্টাডি।" বলেন ঠাম্মা ।

ঋষির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । সে জানে তার ঠাম্মা মিথ্যা আশ্বাস দেন না । সারাজীবনই খুব ডাকাবুকো সাহসী মহিলা হিসেবে তিনি পরিচিত মহলে প্রসিদ্ধ। ঠাম্মার সাথে বেড়ানো মানে মনের প্রচুর খোরাক জুটে যাবে । বাবা বলেন ছোটবেলায় মাকে তিনি যমের মত ভয় পেতেন । এটা শুনে ঋষি খুব হেসেছিল কারণ ঠাম্মাকে দেখে ভয় সে জীবনে পায়নি । এত মিষ্টি করে আদর করে সবটা বুঝিয়ে দেন ঠাম্মা । সব বন্ধুরা বলে কাশ তাদের এরকম একজন গ্র্যানি থাকতো।


“ কোথায় যাবো বলো বলো প্লিজ। আমার আর তর সইছে না।" আদুরে গলায় প্রশ্ন করে ঋষি ।

“ আগে যাও ব্রাশ করে বাবা মাকে গুড নাইট করে এসো । আমাদের প্ল্যান কিন্তু এখনই কিছু বলিস না । যা । " বলেন ঠাম্মা ।


আনন্দে প্রায় লাফাতে লাফাতে নীচে চলে যায় ঋষি । প্রীতি হেসে নিজের খাওয়া শেষ করেন ।

.....


ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে ঋষি মুখ নিচু করে টোস্টে কামড় বসায় । ঠাম্মা ডিমের খোসা ছাড়িয়ে জলে ধুয়ে সবার প্লেটে দিচ্ছেন । সবিতামাসি রান্না ঘরে ব্যস্ত । মা চা ঢেলে সবাইকে দিচ্ছেন । প্রীতম আড়চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকান । মা যে কীসের লোভ দেখিয়ে ঋষিকে শান্ত করলেন বোঝা গেল না ।


“ পুতু শোন তোর সাথে একটা জরুরি কথা আছে । " বলেন প্রীতি ।


অনেক দিন বাদে মায়ের মুখে আদরের ডাক শুনে মন ভরে যায় প্রীতমের । বেশিরভাগ সময় মা নাতিকে দিয়ে ডেকে পাঠান । নাহলে ডাকনাম বাপি বলে ডাকেন । আর রেগে গেলে বলেন প্রীতম ।


“ হ্যাঁ মা বলো । " সাগ্রহে তাকিয়ে থাকেন প্রীতম।

“বসিরহাটের বাগানবাড়ি তে তো অনেক বছর যাই নি । ভাবছি দিন সাতেক আমি আর ঋষি ওখানে গিয়ে থেকে আসবো । " চোখের ইশারায় ঋষির দিকে ইঙ্গিত করেন প্রীতি ।

“ ওখানে যাবে ? আমিও তো যেতে পারিনি বহু বছর । অনিল কাকা বাবার খুবই বিশ্বস্ত লোক বলে এতদিন যত্ন করে রেখেছেন সবকিছু । তাও দোতলার সবকিছু কেমন আছে সেটা খোঁজ নিয়ে দেখি । অনিল কাকারও বয়স হয়েছে । "
বলেন প্রীতম ।

“ খুবই ভালো অনিল আর সুষমা । শুধু মাসে মাসে টাকা আর থাকার বিনিময়ে ওরা যা করে সেটা সত্যি ভাবা যায় না ।ওদের জীবনে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে তাও ওদের প্রভুভক্তিতে কোনো ছেদ পড়েনি । যাক গে ... দোতলা খুলে পরিষ্কার করাতে বলে দে । বাথরুম দুটো যেন ভালো করে সাফ করে । ঋষি তো সেই কোন ছোটবেলায় গেছিল ..ওর ভালোই লাগবে । তুই আজকেই ফোন করে দে । সামনের রবিবার যাবো ভাবছি।" বলেন প্রীতি ।


“ঠিক আছে । রবিবার সকালে তাড়াতাড়ি রওয়ানা হয়ে যাবো । ওখানে দুপুরে দেশি মুরগি আর ভাত খাবো । তোমরা থেকে যেও । আমরা ফিরে আসবো সন্ধ্যা নাগাদ । ঠিক আছে?” প্রীতম বলেন । সবার মুখে বেড়ানোর খবরে আনন্দের আলো জ্বলে ওঠে ।


....


“অনিল দাদুর জীবনে কি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঠাম্মি ? ওঁরা ঐ বাড়িতে থাকেন কেন ?” রাতের বেলা শোওয়ার আগে ঠাম্মির সাথে কিছুক্ষন প্রাণের কথা বলা ঋষির অভ্যাস ।

“আমার শ্বশুর মশাইয়ের বাবা বাংলাদেশ থেকে এদেশে চলে আসেন । ওদেশে প্রচুর জমিজমা ছিল ওঁর। বলতে পারিস জমিদার মানুষ। অনিলেরা বংশপরম্পরায় এই বংশের লাঠিয়াল রক্ষক ছিল । নিজেদের লোক হয়ে গেছে বলা যায়। ওরাই তো এত বছর সব দেখে শুনে রেখেছে ।
সবই ঠিক চলছিল কিন্তু ওর একমাত্র সন্তান অম্বর নিখোঁজ আর তার স্ত্রী রুক্মিণীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় । ওদের মেয়ে বুল্টি তোর থেকে বছর দুয়েকের ছোট । কিন্তু মেয়েটি বোবা হয়ে গেছে । থাক ঋষি এই প্রসঙ্গে আমার আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না । ঘুমিয়ে পড়।” ঠাম্মি চুপ করে যান । 

অনেক সংগত প্রশ্ন মাথায় ঘোরাফেরা করে ঋষির কিন্তু ঠাম্মি যখন চুপ করে গেছেন তখন এর বেশি কিছু তিনি কিছুতেই বলবেন না । দু'চোখ বন্ধ করে মাথা থেকে সবকিছু বার করার চেষ্টা করতে থাকে ঋষি ।


....


পরের রবিবার গোটা চারেক ব্যাগ, ট্রলি বোঝাই করে জিনিসপত্র নিয়ে সবাই মিলে রওয়ানা দিলেন বসিরহাটের দিকে । ঋষি অনেক ছোটবেলায় একবার গিয়েছিল । অনেক গাছ আর একটা খেলার জায়গা তার মনে পড়ে আবছা আবছা । ঠাম্মা এক মুহূর্ত তাকে চোখের বাইরে যেতে দেননি । দুপুরে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল সারাদিন ছুটোছুটি করে । ফেরার সময় গাড়িতে যখন ঘুম ভাঙে তখন সে তার মায়ের কোলে । সে এবার মনে মনে খুবই উত্তেজনা অনুভব করছে ।


যশোহর রোড ধরে এগিয়ে চলছে
প্রীতমের সাধের স্করপিও । ডাকবাংলো থেকে ডান দিকে ঘুরে এগিয়ে চলে গাড়ি ।
এরপর কলকাতা বসিরহাট রোড ধরে কদম্বগাছি গোলাবাড়ি দেগঙ্গা বেড়াচাঁপা পেরিয়ে বসিরহাট সাব ডিভিশনের বাদুরিয়া পৌঁছাতে বেলা বারোটা বেজে গেল । মাঝে একবার কচুরি মিষ্টি আর চা ব্রেক হয়েছিল ।
“সামনেই ইছামতী নদীর উপর কাঁটাখালি ব্রিজ আছে । সকালে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে নদীর পাড় ধরে ঘুরে আসিস ঋষি । ভালো লাগবে । " বলেন প্রীতম ।

“ভালো করে সোয়েটার টুপি ঠুপি পরে যাবি ঋষি। ভীষণ ঠান্ডা হওয়া দেয় নদীর পাড়ে । " বলেন রোমিলা ।


একটু বাদেই কালো রঙের বিরাট উঁচু একটা লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় তাদের গাড়ি। একমানুষ সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা অনেক গাছগাছালির জায়গা পার হয়ে শেষে বহু পুরোনো আমলের একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে।গেটের ডানদিকে দুটি ঘর। সেখান থেকে একজন দারোয়ান গোছের লোক বার হয়ে এসে দরজা খুলে দৌড়ে আসে। লোকটি কাছে আসলে ঋষি চিনতে পারে হরিহর দাদু । যথেষ্ট বয়স হয়েছে কিন্তু টানটান ব্যায়াম করা পোক্ত চেহারা । গতবার ঋষিকে নিয়ে কাঁধে করে ঘুরেছিলেন উনি। ঋষির ঠাকুরদার বাবার সেরা লাঠিয়াল ছিলেন হরিহর দাদুর বাবা । মানুষটি তাদের দেখে যথেষ্ট আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন । বারবার অনুযোগ করলেন ঠাম্মার কাছে কেন তাঁরা বছরে অন্তত একবার করে আসেন না ।

মালপত্র নামানো চলছে । ঠাম্মার হাতব্যাগ থেকে নিজের বাইনোকুলারটা গলায় ঝুলিয়ে গেটের ভিতরে ঢুকে পড়ে ঋষি । বাঁ দিয়ে ছোট ছোট চারাগাছ পোঁতা হয়েছে । গাঁদা চন্দ্রমল্লিকা ডালিয়া আর কিছু অচেনা ফুলের গাছ সযত্নে বেড়ে উঠছে । কিছুটা দূরে অযত্ন মাখা একটা জঙ্গল মতো । একটু হেঁটে এগোতেই ঋষি বুঝতে পারে জঙ্গলের পরেই খুবই বড় মজা পুকুর আছে যা আগাছায় আর বড় বড় জংলা গাছে ভর্তি । আরো সামনে এগিয়ে যায় ঋষি । পুরো জায়গাটা রেলিং দিয়ে ঘেরা ।
“ঋষি ! ওদিকে কেউ যায় না, আগাছায় ভর্তি । সাপখোপ থাকতে পারে। চলে আয় এক্ষুনি । " রোমিলা মাথার উপর সানগ্লাসটা তুলে চিৎকার দেন ছেলের উদ্দেশ্যে ।

ঋষি সবে ভাবছিল বাইনোকুলার চোখে দিয়ে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখবে কিন্তু উপায় নেই । এমনিতেই মায়ের ধারণা কুকুর বেড়াল থেকে কাঠবিড়ালি , মশা মাছি থেকে শুরু করে যাবতীয় কীট পতঙ্গ ওঁৎ পেতে দাঁত বা হুলে শান দিচ্ছে ঋষিকে কামড়ানোর জন্য। ক্লাসে সে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করে দেখেছে সবার মা একই রকম ।


বাইরে মা ছাড়া কেউ দাঁড়িয়ে নেই । শুকনো পাতার উপর দিয়ে আওয়াজ করে হাঁটতে ভালোই লাগছে ঋষির । এখানে সত্যি খুব ভালো ভাবে নেচার স্টাডি করতে পারবে সে । মা আবার তাড়া লাগানোয় অল্প দৌড়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকে ঋষি ।


....


পুরোনো আমলের উঁচু খাটের উপর ধবধবে সাদা চাদর বিছানো । দুটো তাকিয়া কোলে নিয়ে ঠাম্মা আর ঋষি বসে গল্প শুরু করে । ঠাম্মা বলেন


“কাকে দেখে তোর কী কী মনে হলো বল দেখি।"


“অনিল দাদু ,খুব ভালো মানুষ । বাড়ি এবং আমাদের বংশকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন । শ্রদ্ধাও করেন । কথায় কথায় জয় গোবিন্দ বলা অভ্যাস ।
সুষমা দিদা খুব চুপচাপ । গভীর চাপা দুঃখ ওঁর দুচোখে । মাঝেমাঝেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আর বলেন ..সবই কপাল ।
হরিহর দাদু লাঠি হাতে এখনো দশজনকে শুইয়ে দিতে পারেন । তবে সম্ভবত রাতকানা। উনি কী করে রাতে বাড়ি পাহারা দেন কে জানে । ভালো করে তালা লাগাতে পারেন না ।
বুল্টি , অনিল দাদুর নাতনি । বছর দশেক বয়স । কথা বলতে পারে না না চায় না বুঝলাম না । শুনতে পায় সবকিছু । লেখাপড়া করে । খুবই বিষণ্ণ মনমরা মেয়ে ।
আপাতত এইটুকুই ..।” লম্বা বক্তৃতা করে থামে ঋষি ।

“ ভালোই পর্যবেক্ষণ করেছিস দেখছি । " ঠাম্মা হাসেন । 
“ অনিল আর সুষমা দুজনেই বড় হাসিখুশি মানুষ ছিল । আচমকা একমাত্র সন্তান হারিয়ে যাওয়ায় ওরা এরকম হয়ে গেছে । নেহাৎ নাতনি রক্ষা পেয়েছে তাকে নিয়েই ..।”

“ রক্ষা পেয়েছে মানে ! কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিল নাকি ? ” কৌতূহল চাপতে পারে না ঋষি ।


“ বছর পাঁচেক আগে বাংলাদেশ থেকে চাকরি ছেড়ে এখানে চলে আসে অম্বর মানে তোর অনিল দাদুর ছেলে । সে ওখানে মামাবাড়িতে মানুষ হয়েছে । তোর বাবার সাথে ফোনে কথা হয় । নিচের দুখানা ঘর মেরামত করে নিতে মাসখানেক একা এখানে থেকে যায় । তারপর আবার ওদেশে যায় নিজের শ্বশুরবাড়ি থেকে রুক্মিণীকে মানে ওর স্ত্রীকে আর মেয়েকে আনতে । দিন পনের বাদে ফিরে এসে এখানে গুছিয়ে সংসার শুরু করে । অনিলরা খুশি আমরাও খুশি । এর কিছুদিন বাদেই বাড়িতে মাঝরাতে ডাকাত পড়ে । বাড়িতে কিছুই তেমন ছিল না । ডাকাত আসার উদ্যেশ্য কী তাও বোঝা যায়নি । ডাকাতরা বাঙাল ভাষায় কথা বলছিল । ওরা টানতে টানতে অম্বরকে বাইরে নিয়ে যায় । তাকে বাঁচাতে রুক্মিণীও বাইরে যায় । সবার পিছনে ছিল বুল্টি । তারপর মশালের আলো দিয়ে বাইরের খড়ের গাদায় আর মজা পুকুরের আগাছার জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেয় ডাকাতরা। গুলি চালাতে চালাতে তারা চলে যায়। এর ঘন্টাখানেক পর পুলিশ আসে । আশেপাশের লোকেরা ততক্ষনে আগুন নিভিয়ে ফেলেছে । মজা পুকুরের ধারে গুলিতে প্রায় মৃত রুক্মিণীকে পাওয়া যায় । একটু দূরেই একটা গর্তের মধ্যে পড়েছিল অজ্ঞান বুল্টি । দুজনকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে রুক্মিণী একবার চোখ খুলে কোনোমতে একটা শব্দ উচ্চারণ করে ..সেটা তরঙ্গ বা তোরঙ্গ না সুড়ঙ্গ সেটা পুলিশের লোক বা হরিহর কেউই সঠিক বলতে পারেনি । কথাটা বলেই রুক্মিণী মারা যায় । বুল্টি কিছুদিন ভর্তি থাকে হাসপাতালে । শরীরে কোনো আঘাত না থাকলেও তার মনের আঘাত ছিল সাংঘাতিক । আগে সে বাঙাল ভাষাতে কথা বলত । কিন্তু এই ঘটনার পর আর সে কথা বলেনি । এবার ভাবছি ওকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে সঠিক চিকিৎসা করাবো । ”

“ খুব ভালো হবে । আমাদের স্কুলে ভর্তি করে দিও । ওকে আমি বনু ডাকবো ঠাম্মা । ঠিক আছে? ”

“বলিস । ”

“কিন্তু ঠাম্মা পুলিশ কী বললো ? আর অম্বর আঙ্কেলের কী হলো ? ”

“পুলিশ বলেছিল অম্বর কোনো খারাপ দলে মিশতো । তাদের হাত থেকে বাঁচতে সে এদেশে চলে আসে । কোনো পুরোনো শত্রুতার জেরে হয়ত এই আক্রমণ । কিন্তু আজ অবধি অম্বরের কোনো হদিশ পায়নি কেউ । ”



...


সকালে উঠে ঋষি দেখে রান্নাঘরের সামনে একটা বড় জামবাটিতে প্রচুর নারকেল কোরানো হয়েছে। কাঠের জ্বালের উনুনের উপর কড়াইতে খেজুরগুড় জ্বাল দিচ্ছেন ঠাম্মা । বড় একটা শিলে ভিজিয়ে রাখা চাল নোড়া দিয়ে পিষছেন সুষমা দিদা । একটা স্টীলের থালায় বেশ কিছুটা কাজু আর কিশমিশ রাখা আছে । এদিক ওদিক তাকিয়ে একমুঠো কাজু কিশমিশ তুলে নেয় ঋষি। পকেটে চালান করে বলে
“ঠাম্মা একটু বাইরে যাচ্ছি।" 

বাড়ির পিছনে কিছু গাছপালা আর একটা ছোট ডোবা মতো আছে । সেদিকে হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ে তার কাজু চুরি দেখে মুখে হাত চাপা দিয়ে বুল্টি নিঃশব্দে হাসছে । সে বুল্টিকে কাছে ডেকে তাকে চুরির ভাগ দেয় । বাইরে আসতে আসতে শুনতে পায় সুষমা দিদা বলছেন ...“ সবই কপাল। "


ডোবার পিছল ঘাটে সাবধানে দাঁড়িয়ে কাজু কিশমিশ সাবাড় করে দুজনে । বুল্টি ইশারায় ঋষির বাইনোকুলারটা চায় ।
“নে । গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে এইভাবে চোখে দে ।" 

ঋষি দেখে ডোবার অপর দিকে ঘন জঙ্গল । মোটা মোটা লতা গাছ বড় বড় গাছগুলোর গুঁড়িগুলো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জায়গাটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার করে রেখেছে । তার ওপারে বড় পাঁচিলটা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না । বুল্টি দূরের জিনিস স্পষ্ট করে সামনে দেখতে পেয়ে খুবই উত্তেজিত হয়ে ডানদিকে ঘুরতে গিয়ে ঋষিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে । ঋষির পা বেশ কিছুটা পিছলে যায় । কোনমতে ডোবায় পড়া সামলে নিয়ে ঋষি বলে,
“ধাক্কা দিস না রে বনু । সাঁতার জানি না ডুবে যাবো । "


দুচোখে কৌতুক নিয়ে পুরোটাই রসিকতা ভেবে হাসতে হাসতে ঋষিকে ধাক্কা মেরে বসে বুল্টি । টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়ে যায় ঋষি । আপ্রাণ হাত পা ছোঁড়ে । বুল্টি বিস্ময়ে চোখ বড় করে ফেলে । এই বয়সী একটি ছেলে সত্যি সাঁতার জানে না এবং সে ডুবে যাচ্ছে দেখে হতবাক হয়ে যায় । পরক্ষণেই বাইনোকুলার ডোবার পাড়ের কচুপাতার ঝোপে ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে ―“ দাদাভাই ..." তারপর জলে ঝাঁপ দেয় ।


জলের মধ্যে ডুবতে ডুবতে মা ঠাম্মার মুখ মনে পড়ে। অসহ্য কষ্টের মধ্যেই ঋষি টের পায় একটা হাত এসে তার চুল খামচে ধরলো । তারপরেই একবুক বাতাস টানতে পারে সে। তাকে প্রাণপণে পাড়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার ছোট্ট বনু ।


একটু বাদে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে ধাতস্থ হতে সময় নেয় ঋষি । হঠাৎ তার খেয়াল হয় পাশে বসে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছে বনু । সবচেয়ে বড় বিস্ময় বনু কথা বলছে ! কিন্তু এগুলো কী বলছে বনু !

“ তুমি এত্তো বড় পোলা হইয়া জলে ডরাও তুমি সত্যই সাঁতার জানোনা আমি হেইডা জানুম ক্যামনে কও .." বলে আবার কাঁদতে যায় বুল্টি ।

“আরে দাঁড়া দাঁড়া । কী বলছিস ! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না । তুই কথা বলছিস বনু এটা তো দারুণ খবর । চল সবাইকে বলি । ” বলে ঋষি ।

“আরে খাড়াও । এই রকম জল চুপচুপে দুজনকে দেখলে হোগগলে আমাগো পিডাইবো ..অ তুমি তো আবার এই ভাষা বুঝবে না । আমাদের এরকম জলে ভেজা দেখলে সবাই পেটাবে । ”

বুল্টির নির্দেশে সকলের চোখ এড়াতে বাগানের একদম শেষ কোণায় চলে যায় ঋষি । জঙ্গলের ভিতরে বড়বড় গাছের আড়ালে একটা জং ধরা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি । সিঁড়ির গায়েও কিছু জংলি বেগুনি লতা ইচ্ছামত পেঁচিয়ে আছে । তার মধ্যে দিয়েই সাবধানে পা ফেলে উঠতে থাকে ঋষি। দোতলায় একটা কাঠের দরজা। তাতে একটা মাকড়শার জাল ঢাকা ছোট্ট তালা ঝুলছে।

“ এ বাবা !এতো তালা দেওয়া রে বনু । ”

“ খাড়াও । মানে দাঁড়াও ।চাবি আমার গলায় । " ঋষিকে অবাক করে দিয়ে নিজের গলার লম্বা রুপোর চেন একটা লম্বাটে রুপোর কবচের মত লকেট সমেত বাইরে বের করে আনে বুল্টি । কবচের উপর মা কালীর মূর্তি । তার উপর বিশেষ কায়দায় চাপ দিতেই কবচটি খুলে যায় । ভিতরে একটা চাবি দুটো ছোট ছোট আংটা দিয়ে শক্ত করে আটকানো । চাবিটা একটু শক্তি প্রয়োগ করে বার করে নেয় ঋষি । তারপর তালা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখে একটা ধুলো পড়া বিশাল বারান্দা । বহুদিন বাড়ির এই জীর্ণ অংশে কেউ আসেনি । দুজনে প্রায় দৌড়ে পরপর দুটি ইংরেজি এল অক্ষরের মতো লাগোয়া দুটি বারান্দা পেরিয়ে একটা গ্রিলের গেট খুলে ঢুকে পড়ে চেনা জায়গায় । এরপর স্বাভাবিক ভাবে নিজের ঘরে ঢুকে যায় ঋষি । বনু নিচে নেমে যায়। দুপুরে খেয়েদেয়ে ছাদে গিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দেবে বলে কথা দেয় সে ।


নিচে বেশ খুশির উল্লাসধ্বনি শোনা গেল । সবাই খুশি আচমকা বুল্টিকে কথা বলতে শুনে । ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ঋষি । আজ আর একটু হলেই তার প্রাণ চলে যেত ভেবে শরীর জুড়ে কাঁপুনি অনুভব করে ঋষি ।মায়ের বারণ শুনলে এভাবে দুর্ঘটনায় পড়তে হতো না । ঠাম্মা শুনলে বিকেলেই বাড়ি রওয়ানা দেবেন ।ভাগ্যিস সকালে মোবাইল চার্জে বসানো ছিল ।পকেটে থাকলে নষ্ট হয়ে যেত । এখন অনেক প্রশ্ন তার মাথায় কিলবিল করছে । কিছু একটা রহস্য তো আছেই এবাড়িতে । সেটা ভেদ না করা পর্যন্ত কাউকে এ ঘটনা জানানো যাবে না । ঠাম্মা তার বেস্ট ফ্রেন্ড , তাকেও জানানো যাবে না ।


...


শীতের দুপুরে ছাদের উপর বড় বড় গাছেদের মাঝখানের ফাঁকফোঁকর চুঁইয়ে আসা হাল্কা রোদে পিঠ দিয়ে মাদুরে বসে কদবেল মাখা খেতে এত ভালো লাগে ঋষির জানা ছিল না । তারপর গাছের ডাঁসা পেয়ারা ছুরি দিয়ে কেটে কেটে বাড়িতে তৈরি ঝালনুন মাখিয়ে খায় দুজনে ।


“ এবার বল । "
“ হ কইতাসি ..না না বলছি । এখানকার ভাষায় বলছি । তখন আমি ভীষণ ছোটো ।মা বাবাকে অনেক বোঝাতো বাবা যেন খারাপ লোকেদের সঙ্গে না মেশেন । কিন্তু বাবা কথা শুনতেন না । তারপর এই বাড়িতে আসি আমরা । বাবা রাত্রে একটা টর্চ নিয়ে বের হয়ে যেতেন। আমায় গলার এই তাবিজ বানিয়ে দিয়েছিলেন। এক বর্ষার রাতে বাবা মাকে ডেকে তুললেন। বললেন অনেক কিছু পেয়েছেন । এবার আমরা বিরাট বড়লোক হয়ে যাবো । মা প্রশ্ন করাতে বাবা আমাকে কোলে নিয়ে মাকে নিয়ে দোতলায় উঠে কত অন্ধকার পেরিয়ে একটা দরজা খুলে ওই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেন । একদম সীমানা ঘেঁষে ডোবার ঐধার ঘেঁষে হেঁটে চললেন মজা পুকুরের দিকে । তারপর রেলিং এর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
 “এখানেই সব আছে । অনেক ধনরত্ন খাজনা এখান থেকে নদী পথে আসতো সবার চোখের আড়ালে । ডাকাতি ঠেকানোর জন্য । ঠাকুরদার লেখায় এরকম ইঙ্গিত পেয়েছি আমি । "

সেদিন মা ভয় পেয়ে আমায় কোলে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে আসেন । বাবা বলছিলেন এখনো কিছুই পাননি খুঁজে ।কিন্তু কিছু বাজে লোককে কিছু গোপনীয় কথা বলে ফেলেছেন । তারা একদিন ঠিক আসবে । 

এর বেশ কিছুদিন বাদেই রাতের বেলা অনেক লোকের চিৎকার । চারিদিকে মশালের আলো । বাবাকে দুজন লোক এসে বললো কোথায় আছে সব সোনা দানা না দেখিয়ে দিলে বাবাকে মেরে ফেলবে । লোকগুলো বাবাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গেল মা চিৎকার করে পিছনে ছুটলেন আমিও মায়ের পিছনে ছুটলাম । মজা পুকুরের জঙ্গলের ভিতরে বাবা দৌড়ে নেমে গেলেন । ওরা জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিল । দুমদাম আওয়াজ হচ্ছিল । বোধহয় ওরা গুলি করছিল মা আমাকে একটা ময়লা ফেলার গর্তের ভিতর ফেলে দিলেন । তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই । " চোখ ভরা জল নিয়ে চুপ করে যায় বুল্টি ।

“ আমাকে এখুনি একবার জায়গাটা দেখাতে পারবি বনু ? সবাই লেপ চাপা দিয়ে ঘুমাচ্ছে এই ফাঁকে আমরা দেখে আসি । চল । ছুরিটা নে সঙ্গে।" বলে ঋষি ।

“ চল । ” 

ছাদের জলের ট্যাঙ্কের গায়ে লাগানো কল খুলে হাত মুখ ধুয়ে নেয় দুজনে । তারপর চুপিচুপি নেমে আসে দোতলায় বারান্দার শেষ প্রান্তে সেই গ্রিলের গেট খুলে আবার নিঃশব্দে সেটা লাগিয়ে দেয় বুল্টি । এরপর আবার সেই এল আকৃতির দুটি বারান্দা পেরিয়ে পৌঁছে যায় সেই দরজার সামনে । বাইরে বেরিয়ে সাবধানে পা ফেলে নেমে আসে নীচে । সিঁড়ি দিয়ে নেমে বুল্টি মাটিতে ইশারা করে কিছু দেখায় । ভালোভাবে লক্ষ্য করে ঋষি বুঝতে পারে একটি হালকা পায়ে হাঁটা পথ প্রায় পাঁচিলের গা ঘেঁষে জঙ্গলে ঢুকে গেছে । দুজনে দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে নেয় । তারপর বুল্টি আগে হাঁটতে শুরু করে । মাঝে মাঝেই থেমে দুজনে ওই হাঁটা পথে পাতা সরায় পা দিয়ে । ঋষি একটু খুঁজেই বেশ বড় একটা শুকনো ডাল খুঁজে পেয়ে যায় । এবার সে ওই ডাল দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে চলে । মোটামুটি সীমানার পাঁচিলের থেকে দু'ফুট দূর দিয়েই তারা সোজা হাঁটছে । একটু বাদেই বাঁ দিকের ঘন গাছের আড়ালে ডোবাটা দেখতে পায় ঋষি । সকালের দমবন্ধ অবস্থার কথা মনে পড়ে ।
বেশ কয়েক মিটার দূরত্বে এসে তারা মজা পুকুরটি দেখতে পায় । পাঁচিলের গা ঘেঁষে জমিটা বেশ খানিকটা ঢালু হয়ে গেছে । সামনে গাছের প্রহরা থাকায় বোঝা যায় না পাঁচিল এত নিচ থেকে গেঁথে তোলা হয়েছে । ঋষি বুঝতে পারে বাড়ির দিক থেকে কেউ এদিকে তাকালেও তাদের পরিষ্কার দেখতে পাবে না ।


রেলিং ঘেরা জায়গার সামনে এসে তারা দেখে রেলিংটি অনেকটা ভাঙা । সেখান দিয়ে দুজনে ভিতরে ঢোকে । হঠাৎ সরসর করে কী একটা প্রাণী ঋষির পাশ দিয়ে মজা পুকুরের ভিতরে দৌড়ে একপাঁজা ইঁটের পিছনে পালায় । ঋষি বেজায় চমকে ওঠে । বুল্টি মুখে চাপা দিয়ে হাসি সামলায় । তারপর ফিসফিস করে বলে,

“শহুরে পোলা নেউল দেইখ্যা ডরায় ..ওটা বেজি দাদাভাই । বেজি আছে মানে এখানে সাপ নেই । ওটা ওর ঘর ।”

“বেশি পাকামি করবি না । আমাদের অনেকটা নীচে নামতে হবে । কিছু তো আছেই নিচে । পায়ে হাঁটা পথটা প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না , তবু চেষ্টা তো করতেই হবে । সব রহস্যের জট খুলবে এখানে ।” ধীরে ধীরে বলে ঋষি ।


অল্প ঢালু হয়ে আগাছা আর জঞ্জালে ভর্তি মজা পুকুরের গা বেয়ে তারা নিচের দিকে সাবধানে থেমে থেমে নামতে থাকে । 

একটু বাদে একজায়গায় তারা থামতে বাধ্য হয় । পথটা দু'ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে একভাগ বাঁ দিকে বেঁকে মজা পুকুরের কেন্দ্রের দিকে চলে গেছে অন্য ভাগ অল্প ডানদিকে বেঁকে নিচের দিকে চলে গেছে । বুল্টি একটু ভাবে চোখ বন্ধ করে তারপর বলে ,
“ দাদাভাই , অস্পষ্ট ভাবে মনে আছে বাবা ডানদিকে কোনাকুনি ভাবে দৌড়ে নেমে গিয়েছিলেন । চলো । "


দুজনে এবার একটু জোর পায়ে নেমে চলে । অনেকটা নামার পর বড় বড় ইঁট পাথরের একটা প্রায় গোলাকার স্তূপের কাছে এসে পৌঁছায় । কী আশ্চর্য ব্যাপার এটা উপর থেকে দেখাই যায় না । কারণ আগুনে পুড়ে পুরো জায়গাটা কালো হয়ে গেছে তারপর জঙ্গল জন্মেছে । সামনে এলে বোঝা যায় এগুলো পাথর আর ইঁট । কিন্তু পুকুরের এক ধার ঘেঁষে এসব কে ফেলে রেখেছে। আর কেন ?


স্তূপাকৃত ইঁট পাথরের পিছন দিকে যায় দুজনে । বেশ বোঝা যায় একটা গর্তের মুখ । সামনে সাপের মত বুনো লতা ঝুলছে । বুল্টির হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে লতা গাছ গুলো কাটতে শুরু করে ঋষি ।

“ বুঝতে পারছিস ? এটা একটা সুড়ঙ্গ । আন্টি মানে তোর মা মারা যাওয়ার আগে এর কথাই বলেছিলেন মনে হচ্ছে রে বনু । দাঁড়া আমি ভিতরে ঢুকি । তারপর তোকে ডাকবো । যদি মিনিট দশেকের মধ্যে না বার হয়ে আসি তাহলে বাড়িতে খবর দিবি ।" বলে ঋষি ।

"কি কইতাস তুমি ! আমাকে বাচ্ছা ঠাউরেছ নাকি ! আমি তোমার সঙ্গে যাবো দাদাভাই । চলো। "


পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে ঋষি । এখন সাড়ে চারটে । বড় বড় গাছের ছায়ায় তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামে । এখন বনুর সাথে তর্ক করতে গেলে বিপদে পড়তে হবে । কথা না বাড়িয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকে যায় সে । পিছনে তার বনু । সুড়ঙ্গ ডান দিকে বেঁকে গিয়েছে । উপর থেকে যাতে না দেখা যায় তাই সুড়ঙ্গের মুখ দাদুর ছাতার বাঁটের মত ঘুরিয়ে করা হয়েছে বলে মনে হয় ঋষির । ডানদিকে ঘুরে সে দেখে তার ধারণাই ঠিক লম্বা সরু একটা পথ ক্রমশ অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে । মোবাইলের টর্চ জ্বেলে নেয় ঋষি । দুজনে সামনে হাঁটে ।


“ এখান থেকে নদী কত দূরে রে বনু ? "

“ খুব দূরে নয় । "


“আরে ওটা কী! " চমকে উঠে বলে ঋষি । 

একটু দূরেই শ্যাওলা ধরা দেওয়ালের বেশ কিছুটা অংশ ভেঙে পড়েছে । তার সামনে গিয়ে দুজনে দেখে একটা শাবল পড়ে । মাটির চাঙ্গরের ভিতর একটা বাক্স মতো কিছু আর একটা কঙ্কালের হাত দেখা যাচ্ছে । 


“ বাবা ! হাতে পলা বাঁধানো আংটি! " 

ডুকরে কেঁদে ওঠে বুল্টি । তারপর দুহাতে ছোট ছোট চাঙ্গরগুলো সরাতে থাকে । ঋষি পটাপট কয়েকটা ফোটো তুলে নেয় । তারপর সেও চাঙ্গর সরাতে থাকে । একটা ধুলো মাখা কঙ্কাল দুহাতে একটা পুরোনো কাঠের বাক্স আঁকড়ে ধরে আছে । জোরে কেঁদে ওঠে বুল্টি । ঋষি ওকে ধরে পেছনে টেনে আনে । তারপর বলে 

“ এটা পুলিশ কেস রে বনু ।ধরিস না । পাশের দেওয়ালে দেখ .."


দেওয়ালের কিছু অংশ ধসে পড়েছিল আগেই । বাকি অংশ খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় ওটা দেওয়াল আলমারি গোছের কিছু । ফাটাফাটা অংশের মধ্যে দিয়ে আরো একটা বাক্সের কোনা দেখা যাচ্ছে ।


“ গুপ্তধন । আমার ঠাকুরদার বাবার বাংলাদেশের এক জায়গায় জমিদারি ছিল । মনে হয় নদীপথে সেগুলো এনে এখানে লুকিয়ে রাখা হতো । চল একটা বাক্স খুলে দেখি কী আছে ।” হাতে শাবলটা উঠিয়ে নিয়ে যে বাক্সটার মাথার দিকটা ভাঙা ছিল তার গায়ে সজোরে আঘাত করে ঋষি ।

ঝন ঝন করে তিন চারখানা সোনালী চাকতি মাটিতে ঝরে পড়ে । তার পিছনেই চোখের পলকে সরসর করে নেমে আসে প্রকান্ড ফণাওয়ালা এক বিষাক্ত ক্রুদ্ধ কেউটে ।

“দাদাভাই ! পালাও ।" 
বলে ঋষির হাতে টান দিয়ে দৌড়ায় বুল্টি । হতভম্ব ঋষি একই দিনে দুবার সাক্ষাৎ যমের মুখোমুখি হয়ে মনোবল হারিয়ে দৌড়াতে থাকে মরিয়া হয়ে ।


আধঘন্টা বাদে হরিহর দাদু আর অনিল দাদু দুটো মোটা লাঠি আর মশাল হাতে সুড়ঙ্গ থেকে দেওয়ালের ভিতরে থাকা বাক্সটা বার করে এনে পুলিশে খবর দেয় । সুড়ঙ্গ থেকে বার করে অম্বরের কঙ্কাল আর তার আঁকড়ে ধরে থাকা বাক্স নিয়ে যায় পুলিশ । দশটার মধ্যে প্রীতমরা পৌঁছে যান । বাড়িতে পুলিশ পোস্টিং হয় রাতে ।
....


কাগজের রিপোর্টার টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকার পুলিশের জেরা সব সেরে রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বসার ঘরে সবাই জড়ো হন । একটা ঝড় বয়ে গেছে পুরো পরিবারের উপর দিয়ে । দুটো ক্ষুদে সদস্য একজন ক্লাস সিক্স একজন ফোর ..তাদের উপস্থিত বুদ্ধি এবং গোয়েন্দাগিরির ফলে পরিবারের এতবড় ইতিহাস উন্মোচিত হলো । সুড়ঙ্গ থেকে আনা বাক্সটি এনে সেটার ঢাকনা সাবধানে ভাঙা হয়েছে ছাদে নিয়ে গিয়ে । যদি আরো সাপখোপ থাকে এই আশঙ্কায় । সেটা নামিয়ে এনে বসার ঘরে রাখেন হরিহর । সাবধানে ভিতরের সোনার টাকা বার করতে থাকেন অনিল ।
ভিতর থেকে একটা ছোট রূপার বাক্স বার করে এনে প্রীতমের হাতে দেন অনিল । বাক্স খুলে প্রীতম বার করে আনেন একটি ভাঁজ করা কাগজ । সেটা একটি অতি পুরোনো চিঠি । প্রীতম জোরে জোরে পড়েন


“ এই বাক্সে গচ্ছিত সোনা ডানা সবই
প্রজাদের উপর জোর জুলুম করে আদায় করা খাজনার টাকা থেকে কেনা । আমার যে উত্তরপুরুষ এর সন্ধান পাবে তার উপর আমার আদেশ রইলো সে যেন এর থেকে যৎসামান্য নিজের কাছে রেখে বাকিটা কোনো হাসপাতাল তৈরির কাজে ব্যবহার করে । অনেক অভিশাপ আর অনেক কান্না লেগে আছে এর গায়ে । এগুলো লুকিয়ে রেখে গেলাম । কিছুতেই হাতে ধরে ধ্বংস করতে পারলাম না । তোমাদের সবার মঙ্গল হোক "
আশীর্বাদক
শ্রী বিল্বমঙ্গল গঙ্গোপাধ্যায়


সবাই চুপ করে থাকে । ঠাম্মা বলেন 

“সেই ভালো পুতু । ওর থেকে পাঁচ খানা মোহর অনিলকে পাঁচখানা হরিহরকে আর পাঁচখানা আমাদের জন্য রাখ । বাকি সব বিক্রি করে ওই মজা পুকুরের উপরেই হাসপাতাল তৈরি করে দে। বিল্বমঙ্গল সেবাসদন । বিনামূল্যে চিকিৎসা করিস বাবা । সবাই তোকে আশীর্বাদ করবেন । "

“ তাই হবে মা । তাই হবে । মা আমরা কাল সকালে বের হবো । বুল্টিকে সঙ্গে নিয়ে যাবো । ও আমাদের কাছেই থাকবে । পড়াশোনা করবে । ঠিক আছে ? যা বুল্টি জামাকাপড় গুছিয়ে নে । "

প্রীতমের কথা শুনে বুল্টি হাসিমুখে নিজের ঘরের দিকে দৌড়ায় । পিছনে তার প্রিয় দাদাভাই।।


অলঙ্করণ : আবির

No comments:

Post a Comment