অসময়ে ঘুম ভাঙলে কারই বা ভালো লাগে? বরেন গোস্বামীর শুধু ঘুম ভেঙেছে তাই নয়, ঘুম ভাঙা থেকে এখনও অব্দি সাড়ে ষোলোটা হাঁচি গুনেছেন। ষোলো নাম্বারের পরের হাঁচিটা শুরু হয়েছিল, শেষ হয়নি। তাই সাড়ে ষোলো। ঘড়িতে রাত তিনটে বেজে দশ। অসময়ে এলার্ম কেন বাজল? গত পাঁচ বছর ধরে যার একটিও হাঁচি হয়নি, তার হঠাৎ এই রাতদুপুরে হাঁচি হবে কেন? অনেক ভেবেও কোনও কারণ খুঁজে পেলেন না। ঘরে নাকে দেবার কোনও ড্রপট্রপ আছে কিনা তা খোঁজার তোড়জোড় করতে করতে আরও আটটা হাঁচি হল। এবারে ঘাবড়ে গেলেন বরেনবাবু। হচ্ছেটা কী? প্রতিবছর নিয়ম করে এককাঁড়ি টাকা খরচ করে ফ্লু-এর টীকা নেওয়াটা কি তাহলে বৃথা? বাপিডাক্তারকে কালকেই পাকড়াও করতে হবে। বলে কিনা, ‘ষাট তো পার করে দিয়েছেন, এবার থেকে প্রতিবছর ফ্লু-ভ্যাকসিন না নিলে কপালে দুঃখ আছে। ছোটোখাটো সর্দি-কাশি-হাঁচি থেকে শুরু হবে, তাপ্পর জ্বর হয়ে সোজা নিউমোনিয়া। তা সেই ভয়েই প্রতিবছর টীকা নেন বরেনবাবু। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নেন। গতকালই নিয়েছেন একটা। আর সত্যি বলতে কি, তারপর থেকে এক-দু বার জ্বর হলেও হাঁচি-কাশি-সর্দি নৈব নৈব চ। গত পাঁচবছরে একদিনও হয়নি। অম্বল, বুকজ্বালা, চোঁয়া ঢেকুর, লোমফোঁড়া, পেট খারাপের মত মামুলি অসুখ হয়েছে, কিন্তু হাঁচি-কাশি নয়। হাঁচি হলে নাকের ভেতরটা একটু সড়সড় করে, ভেজা-ভেজা মনে হয়, কিন্তু সেরকম লাগছে না। বুক ভরে লম্বা একটা শ্বাস টানলেন,কই অন্যরকম কিছু মনে হল না তো! তাহলে? স্পষ্ট হাঁচির শব্দ শুনেছেন, হাঁচি গুনেছেন অথচ হেঁচেছেন বলে মনে পড়ছে না। তাহলে হাঁচল কে? এইবার যেন একটু ভয়ভয় লাগছে। অঙ্কের মাস্টারমশাই হলে হবে কী, ভূতে বরেনবাবুর বড়ই ভয়। ভূতের ভয়ে জীবনে বিয়ে পর্যন্ত করেননি। পঁচিশ বছর আগে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর পাত্রীকে ভূতে ধরেছিল, ওঝা ডেকে ঝাড়ানো হয়েছিল সে মেয়েকে। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ওসব কুসংস্কার মেনে নিয়ে বাতিল করে দিয়েছিলেন বিয়েটাই। আর কোনওদিন ছাদনাতলায় দাঁড়াননি। আর এখন ছাদের তলায় নিজের ঘরে বসে হাঁচির উৎস খুঁজছেন। খুঁজে পেলে যে মোটেই ভালো হবে না, সেটা বুঝতে পেরে অন্ধকারে আগাপাশতলা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন বরেনবাবু।
অসময়ে ঘুম ভাঙলে কারই বা ভালো লাগে? তপুর শুধু ঘুম ভেঙেছে তাই নয়, ঘুম ভাঙা থেকে এখনও অব্দি সাড়ে ষোলোটা হাঁচি হয়ে গেছে। ঘড়িতে রাত ৩টে বেজে ১০। এই অসময়ে এলার্ম? নিঝুম রাতে ওর হাঁচি আর কুকুরের ভৌ-ভৌ ছাড়া আর কিচ্ছুটি শোনা যাচ্ছে না। ঢুলতে ঢুলতে হাঁচছে, হাঁচতে হাঁচতে ঢুলছে। ষোলো নম্বর হাঁচির পরেরটা শুরু হয়েছিল কিন্তু শেষ হয়নি, তাই সাড়ে ষোলো। হাঁচির আওয়াজে মা-বাবা জেগে গেছে। ছোট বোনটা অবশ্য ঘুমুচ্ছে। উঠোনের আলো জ্বলে উঠল। মানে, বাড়িসুদ্ধ সবাই উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। বাকি রাতটুকু জেগে কাটাতে হবে বলে দুঃখ নেই তপুর, দুঃখ হল সাঁতার শেখার নামে পুকুরের জলে দাপাদাপির সুযোগ হাতছাড়া হওয়াতে। এদিকে কাল ভুলুদার কাছে সাঁতার শিক্ষার দ্বিতীয় পাঠ। ভুলুদা বলেছে কালকের দিনটা ঠিকঠাক উতরে গেলে তপুর পক্ষে পুকুরটা এপার-ওপার করা কোনও ব্যাপারই না। এসব কথা ভাবতে ভাবতে আরও আটবার হেঁচে ফেলল তপু।
এটা কী হল? রাত তিনটে বেজে দশ মিনিটে হাঁচল তপু। গুণে গুণে সাড়ে চব্বিশখানা। আর ওদিকে বরেন গোস্বামী সেই হাঁচি শুনতে পেল। এটা তো শুধু অদ্ভুতুড়ে নয়, কিম্ভুতুড়ে ব্যাপারস্যাপার। অচিন্ত্যপুরে এর আগেও অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ঘটেছে। জনাবাবুর ছাগল মুক্তিপিসির গোয়ালে পাওয়া গেছে। ফুলির ভূগোলের বই হরিদের কুয়োতলায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সেগুলোর পেছনে পকাই চোরের হাতযশ আছে বলে কানাঘুষোয় শোনা যায়। কিন্তু রাতদুপুরে তপুর হাঁচি অঙ্কের স্যর বরেনবাবুর কানে যাওয়াটার পেছনে তো আর পকাইয়ের হাত থাকতে পারে না। তাহলে?
অচিন্ত্যপুরের মত ছোট জায়গায় যেখানে হাওয়ার থেকেও জোরে খবর ছোটে, সেখানে বরেনবাবুর হাঁচির মত মুচমুচে খবর চাউর হতে বেশী সময় লাগার কথা নয়। তাই হাটে-বাজারে, মন্দিরে, পুকুরপাড়ে সর্বত্র একটাই আলোচনা হতে লাগল।
বামাচরণ জ্যোতিষী বলল, "বরেন গোস্বামীর রাহু কেতুর ঘাড়ে চেপে বসে শনিকে ধাক্কা মারছে, তাই এসব হচ্ছে। সাড়ে চোদ্দ রতির পান্না ধারণ করতে হবে। মাদুলি বানিয়ে ঝোলাতে হবে গলায়। তবেই কাটবে বিপদ।"
শ্যামা দারোগা তো নিশ্চিত এ আর কারুর কান্ড নয়, পকাই চোর ছাড়া। সেদিন নিশ্চয় রাতে চুরির মতলবে গিয়েছিলো বরেনবাবুর বাড়ি। হাঁচির শব্দে ওঁর ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চুরি না করেই সরে পড়েছে।
স্কুলের ফিজিক্সের ভবানী স্যর তো বলেই দিলেন এর পেছনে পিওর ফিজিক্স আছে। ফোর্থ ডাইমেনশন। দৈর্ঘ, প্রস্থ, উচ্চতা এই থ্রি ডাইমেনশন ছাড়া জগতে আরেকটা ডাইমেনশন রয়েছে, সেটা হল সময়। একটু জটিল বিষয় হলেও এই ফোর্থ ডাইমেনশনে এক স্থানের ঘটনা অন্য স্থানে টাইম-ট্রাভেল করতেই পারে। বিষয়টা নিয়ে ভবানীবাবু নিজেও বেশ বিভ্রান্ত। তাই ইচ্ছে থাকলেও সহশিক্ষকদের জলবৎ তরলং করে বুঝিয়ে উঠতে পারলেন না।
ভূতবিশারদ ষষ্ঠীবরণের মতে এ কাণ্ড লম্বোদরের ছাড়া আর কারুর হতে পারে না। গত বৈশাখে ট্রেনে কাটা পড়েছিল লম্বোদর। নাকটা পুরো থেঁতলে গিয়েছিল। তাই বেশিরভাগ সময়েই হেঁচে বেড়ায় সে। ভূতসমাজে তার নামই হয়ে গেছে হেঁচোভূত। আর এসব গুপ্তকথা ষষ্ঠীবরণ জানতে পেরেছে ভূতসিদ্ধ যজ্ঞের সাহায্যে। এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় একটাই। মহাভূতবিতাড়ন যজ্ঞ।
ওদিকে বাপি ডাক্তার সব শুনেটুনে বললেন, "দুটো কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে। এক হল অডিটরি হ্যালুসিনেশন। ভুল শোনা। আর দু নাম্বার হল অ্যালঝেইমার্স। নিজে হেঁচে ভুলে যাওয়া।"
সব থেকে বেশি বিপদে পড়েছে তপু। কারণ অঙ্কের স্যর বরেনবাবুর স্কুলই তপুর স্কুল। সে ঐ স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। স্যরের ভয়ে ওর হাত-পা পেটের ভেতর সিঁধিয়ে যাচ্ছে। শাস্তিস্বরূপ পাটিগণিতের কঠিন কঠিন অঙ্ক যে ঘাড়ে নাচছে, এ বিষয়ে তপু নিশ্চিত।
তবে না, তপুকে এযাত্রা আর পাটিগণিতের ধাক্কা সইতে হয়নি। হাঁচির ঘটনার পর বরেনবাবু কেমন মিইয়ে গেলেন। নানান মতামতের মধ্যে ষষ্ঠীবরণের ব্যাখ্যাই মনে ধরল ওঁর। ভূত তাড়ানোর জন্য যজ্ঞ করালেন। একা একা না থেকে বাড়িতে ছাত্রদের ডেকে অঙ্ক শেখাতে লাগলেন। না, এর জন্য কোন পারিশ্রমিক নিতেন না উনি। কয়েক দিনের মধ্যে ছেলেপুলেদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠল। রাগী মাস্টার নয়, ছাত্রদের সাথে বন্ধুর মত সহজভাবে মিশে দেখলেন, আরে এ তো দারুণ ব্যাপার। ছেলেরা পটাপট অঙ্ক করে ফেলছে। পরীক্ষাতে আট-নয়ের ঘরে মার্কস। বরেনবাবুর এমন ব্যবহারে ছেলেরাও বেজায় খুশি। অঙ্ক ওদের কাছে এখন আর আতঙ্ক নয়, বরং একদিন সন্ধেবেলা বরেনবাবুর বাড়ি না যেতে পারলে ওরা ছটফট করে, কিচ্ছু ভালো লাগে না। দেখতে দেখতে অচিন্ত্যপুরের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা অঙ্কে এক্সপার্ট হয়ে উঠল। তবে এর পেছনের কারণ যে অঙ্কে ফেল হওয়ার মত ঘটনা ছিল, সেটা কেবল জানত ভোলা, শান্তনু, হর, সজল, তপু আর বাপ্পা।
হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় অঙ্কে ক্লাসের সবকটা ছেলে ফেল করেছিল। অন্য সব বিষয়ে সবাই পাশ করলেও অঙ্কে একজনও পাশ করতে পারেনি। এই ব্যাপারটা রাণী ভবানী স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর কারুরই ভালো লাগেনি। সবাই না করলেও ছ’জন মিলে প্ল্যান করল স্যরকে এর উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। ভেবেচিন্তে ঠিক করা হল স্যর নিজের সম্পর্কে যে দুটো জিনিস সব্বাইকে বলে বেড়ায়, সেই ভূতের ভয় আর হাঁচি-প্রতিরোধক ভ্যাকসিনকেই কাজে লাগাতে হবে স্যরকে জব্দ করার জন্য। প্ল্যানমাফিক তপুর হাঁচি রেকর্ড করা হল ফোনে। এলার্ম দিয়ে ঠিক রাত তিনটে বেজে দশ মিনিটে উঠে হাঁচতে শুরু করেছিল তপু, নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে। সবাইকে বলেছিল প্রথমে সাড়ে ষোলো আর পরে আট, মোট সাড়ে চব্বিশটা হাঁচি হেঁচেছে। ওদিকে বরেনবাবুর বাড়িতে চুপিচুপি ঢুকে প্রথমে এলার্ম বাজিয়ে জাগিয়ে দিয়েছিল ভোলা আর বাপ্পা। তারপর সাড়ে চব্বিশটা হাঁচি বাজানো হয়েছিল ফোন থেকে। আর তাতেই কেল্লাফতে।
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণ : দিব্যেন্দু গড়াই
No comments:
Post a Comment