আজ দিনতিনেক হল পুটু মামাবাড়ি এসেছে, তবে ‘মামাবাড়ি ভারি মজা' ব্যাপারটা খুব একটা বোধ করছে না পুটু। কারণ সামনেই তার সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষা আর পুটুর মামা ইতিহাসের মাষ্টারমশাই। ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষায় পুটু ইতিহাসে পঞ্চাশে নয় পেয়েছে এই কথা জানার পর থেকে মামা পুটুকে যখন তখন ইতিহাস পড়াতে বসাচ্ছেন, আর বিদঘুটে বিদঘুটে সব গাল দিচ্ছেন। পুটুর মন খুব খারাপ। এমনিতেই মা নেই কাছে তার ওপর আবার মামার এই জুলুমবাজি।পুটুর মা বাবা বোন দিনদিনকে নিয়ে গেছে ভেলোরে, দিনদিন মোটে বছর দুয়েকের খুকি।জন্ম থেকেই দিনদিনটা খালি ভোগে আর ভোগে।বাপি মা আর দিনদিনের সাথে পুটুরও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাধ সাধল ইতিহাসের নম্বর আর মামা। মামা ভীষণ কড়াভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তার ভাগ্নে হয়ে এই ধরনের বিতিকিচ্ছিরি নম্বর পাওয়া পুটুর মোটেই উচিত হয়নি! তাই এবার মামা পুটুকে পড়াবেন যাতে সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষায় ইতিহাসে হাইয়েস্ট নম্বর পায় পুটু ক্লাসে। মামাকে সবাই খুব ভয় পায়, মাষ্টারমশাই যে! তাই মা-ও খুব আদর করে বলেছিলেন-“সোনাবাবা আমার এই ক'টাদিন মামাবাড়ি তে থেকে যাও, পরীক্ষা হয়ে গেলে তোমায় ঘুরতে নিয়ে যাব!”। পুটু তো খুব গুড বয়, তাই মায়ের কথা মেনে নিয়ে মামাবাড়িতেই থেকে গেল। সমস্যা গভীরতর হয়ে গেল যখন পুটু মামাবাড়িতে এসে দেখল যে তিন্নি গরমের ছুটি কাটাতে ওর মামাবাড়ি চলে গেছে, মামীমাও গেছেন। তিন্নি পুটুর মামাতো বোন,পিঠোপিঠি হওয়ায় খুব ভাব দুজনের। মামাবাড়িতে এখন শুধু দিদিমা আছেন, মামা আছেন আর আছেন রান্নার মালতীমাসি। বর্তমানে পুটুর সারাদিনের রুটিন মোটামোটা ইতিহাসের বই মুখে নিয়ে বসে থাকা, আর মামাকে পড়া দেওয়া। এর মাঝে দিদুনের আদর আর মালতীমাসির সুস্বাদু রান্নাই পুটুকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মালতীমাসি এবাড়িতে রান্না করলেও দিদুন ওকে নিজের মেয়ের মতই দেখেন। মালতীমাসি নাকি এ বাড়িতেই জন্ম হয়ে মানুষ। মালতীমাসির বাবা নাকি মা আর মামাকে মানুষ করেছিলেন কোলেপিঠে। তাঁর কথা উঠলে এখনও দিদুন চোখে আঁচল চাপা দেন।
আজ সকাল থেকে পুটুর আধাঁর ঘনাানো মুখে একটু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। কারণ আজ মামা বাড়ি থাকবেন না। তিন্নি আর মামীমাকে আনতে যাচ্ছেন। আজ রাতে ফিরবেন না।সকালের জলখাবার খেয়ে মামা গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেলেন, মালতীমাসিকে বারবার বলে গেলেন পুটু যাতে পড়াশুনো করে, টো টো করে না বেড়ায়। মামা বেরিয়ে যেতেই পুটু বইটই ফেলে দিয়ে নাচতে লাগল, আহ:! কত্ত দিন বাদে শ্বাস ফেলে বাঁচল পুটু! তারপর মালতীমাসিকে বলেই ছুট্টে বেরিয়ে গেল মামাবাড়ির বাগানে।মালতীমাসি কিছু বললেন না, মুচকি হাসলেন শুধু। বাগানে গিয়ে আমগাছে চড়ে দোল খেল কিছুক্ষণ পুটু, কিছুক্ষণ মুরগির বাচ্চাদের পেছনে ছুটল, তারপর কামরাঙাগাছে চড়ে বাগান থেকে ছেড়া শুষনিপাতার টকটক ডাঁটি ডাঁটি চিবাতে চিবাতে ভাবতে লাগল আর কী করা যায়! এমন সময় একটা গুরুগম্ভীর গলায় কথা এল-“এ কী খোকাবাবু! ওখান থেকে পড়ে হাত পা ভাঙবে তো!”- পুটু ঝটপট গাছ থেকে নেমে এল,তারপর চারিদিকে খুঁজতে লাগল কথককে। কিছুদূরেই ধুতি গেঞ্জি পরা একজন বছর পঞ্চাশেকের লোক একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে বেশ একটা হাসিহাসি আমুদে ভাব তার। পুটু জিজ্ঞেস করল-“তুমি কে গো?” লোকটা হাসিমুখেই বলল-“আমি দীননাথ গো খোকাবাবু, আর তুমি তো পুটু?” পুটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল-“ওমা তুমি আমার নাম জানলে কী করে!?” লোকটা কিছু বলল না শুধু হাসল একটু। পুটু একটু সতর্ক হয়ে গেল,মা বলেছে অজানা অচেনা কোনও লোকের সাথে কথা না বলতে। কিন্তু এই লোকটাকে তো তেমন মনে হচ্ছে না! লোকটা এবার বলে উঠল-“আমি তোমার অজানা নই গো, আমার চেয়ে চেনা আর কেউ নেই তোমার!” পুটু অবাক হয়ে বলল-“তুমি কি মনের কথা বুঝতে পার!?” লোকটা হেসে বলল-“ মামাকে বলবে এই দীননাথের কথা,দেখবে সে কী বলে!” মামার কথা উঠতেই পুটুর অভিমান ফিরে এল, সে ইতিহাসে নয় পাওয়া থেকে শুরু করে দিনদিনের অসুখের কথা, মা বাপির ভেলোর যাত্রা, মামার জুলুমবাজি সব বলে ফেলল।সব শুনে দীননাথ মাথা নাড়িয়ে বলল-“তবে এত্ত সাহস নন্টের! আচ্ছা আমি খুব বকে দেব ওকে”।মামার ডাকনাম নন্টে,মামাকে যে কেউ বকতে পারে এ যেন বিশ্বাসই হতে চায় না পুটুর।কিছুক্ষণের মধ্যেই পুটুর খুব ভাব হয়ে গেল দীননাথের। সারাদিনটা বেশ মজায় কেটে গেল পুপুর। দীননাথ কত গল্প জানে! রাজারানির গল্প, যুদ্ধের গল্প, স্বাধীনতার গল্প! ইতিহাসের ভয় যেন কোথায় উড়ে গেল। দীননাথ জাম পেড়ে খাওয়ালো পুটুকে, পুটুর বানানো কামরাঙাগাছের ওপর ট্রি হাউস দেখে দীননাথ তো মুগ্ধ! একসময় মায়ের নরম হাতের মত বিকেল নেমে এল।দীননাথ আর পুটু এগিয়ে চলল বাড়ির দিকে,বাড়িতে ঢোকার মুখে দীননাথ বলল-“শোনো খোকাবাবু,তুমি এগোও আমি আসছি আর চিন্তা কোরোনা, দিনদিন দিদিভাই ভালো হয়ে যাবে!” পুটুর চোখের সামনে দিনদিনের কচি মুখটা ভেসে উঠল।পুটু বলল-“আচ্ছা তোমায় কী বলে ডাকব আমি?” লোকটা হেসে বলল-“আমি তো সবার দীননাথ! তোমার,মায়ের,মামার সবার!” পুটু বলল-“আচ্ছা!” তারপর কানে কীসের শব্দ যেতে ঘাড় অন্যদিকে ঘোরালো, তারপর আর দীননাথকে কোত্থাও দেখল না।
দুদিন পরে দিদুনের কাছে গল্প শুনছিল পুটু আর তিন্নি।হঠাৎ মামা আর মায়ের একটা ছোট্টবেলার ছবির দিকে চোখ গেল পুটুর। মামা আর মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে এ কে! এ তো দীননাথ!।পুটু জিজ্ঞেস করতে দিদুন বলল-“ও তো দীননাথ দাদুভাই! তোমার মালতীমাসির বাবা,তোমার মা আর মামাকে তো দীননাথই কোলেপিঠে বড় করলে, তারপর যেদিন তুমি জন্মাবে সেদিন ডাক্তারবাবুকে ঠিক সময়ে দীননাথ না নিয়ে এলে যে কী হত! জন্মের পর দীননাথই তোমাকে প্রথম কোলে নিয়েছিল দাদুভাই, তারপর যেইদিন তুমি তোমার বাড়ি যাবে সেদিনই দীননাথকে সাপে কাটল! আহা সে যদি আজ থাকত!” এত্তখানি একটানা বলে দিদুন নিয়মমত কাঁদতে বসল।তিন্নিও ঠাম্মাকে দেখাদেখি ফোঁপাতে লাগল।কেউ মরে যাবে এটা তিন্নি মানতে পারে না।পুটু চুপ করে থাকল , কিচ্ছু বলল না।
মাসখানেক পরে সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষায় পৌলস্থ্য রায় ইতিহাসে পেল পঞ্চাশে তেতাল্লিশ। হাইয়েস্ট মার্কস নয় যদিও! তবে দীননাথ বলেছিল –“সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেলে কি না সেটা জরুরি নয় দাদুভাই! বিষয়টা ভালোবাসছ কিনা সেটাই জরুরি”। মামাকে নম্বর জানানো হলে মামাও সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই কথাই বললেন। মা,বাপি ফিরেছে বেশ কয়দিন হল।ডাক্তার বলেছে দিনদিন এখন একদম ফিট!। ইতিমধ্যে মাষ্টারমশাই হিসেবে মামার কদর খুব বেড়ে গেছে।পুটুর পাশাপাশি মামার পড়ানোরও খুব খ্যাতি করছে সবাই। পুটু অবশ্য জানে যে এই তেতাল্লিশ নম্বর মামার পড়ানোর জন্য ও পায়নি পেয়েছে দীননাথের বলা গল্পগুলো শুনে। দীননাথ ওকে বলেছিল হিস্ট্রি মানে হিস স্টোরি,তার গল্প।পুটু সেই গল্পগুলোকে ভালোবাসতে শিখে গেছে।
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী
No comments:
Post a Comment