লোককাহিনী : রক্তচোষা দেবতা : রাজীবকুমার সাহা




​রাজন্য ত্রিপুরার এক্কেবারে গোড়ার দিককার কথা।

​রাজমহিষী হীরাবতী ছিলেন অন্যসব রাজ-অন্তঃপুরবাসিনীদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। শুধু অন্দরমহলে শুয়ে বসে দিন কাটাতেন না তিনি। রাজসংসারের নিত্য কাজকর্ম নিজের হাতে করতে পছন্দ করতেন। সাধারণ ছিল তাঁর জীবনযাপন।

​এক আষাঢ়ের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে বর্ষাঘন সন্ধের মুখে তিনি রাজবাড়ি-সংলগ্ন নদীতে নামলেন সান্ধ্যস্নান সারতে। স্নান-শেষে কাঁখের রুপোর কলসি ভরে নেওয়ার উপক্রম করতেই কানে এল মিলিত গলায় এক আর্ত চিৎকার, “রক্ষা করুন, রাজমাতা! রক্ষা করুন আমাদের!”

​তারপর আবার, বারংবার। অথচ চতুর্দিকে কেউ কোথাও নেই। হীরাবতী প্রথমে খানিক হতভম্ব হয়ে গেলেও অচিরেই বুঝে গেলেন, নির্ঘাত বিপদে পড়েই ডাকছে কেউ। রাজমহিষীর সঙ্গে রসিকতা করার মতো প্রজা তাঁর রাজ্যে নেই।

​ঘাট বেয়ে ওঠে তিনি রওনা হলেন সে আর্ত চিৎকারের উৎস সন্ধানে। কিছুদূর এগিয়েই থমকে দাঁড়ালেন। দেখেন, একদল প্রজা এক শিমুলগাছকে ঘিরে বেজায় শোরগোল বাধিয়েছে। সে গাছের গুঁড়িতে প্রকাণ্ড দুই শিং বাগিয়ে আঘাতের পর আঘাত হেনে যাচ্ছে কোথাকার এক দৈত্যাকার ষাঁড়। প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসছে সে। শিংয়ের সজোর প্রহারে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে গাছ। আর শিমুলের সুউচ্চ শাখায় শাখায় পরিত্রাহি রব। চৌদ্দ শাখায় বসে থরথর কেঁপে চলেছেন চৌদ্দজনায়।

​রানিমা চোখ তুলে শুধান, “কারা তোমরা? কী তোমাদের পরিচয়?”

​শিমুলের উচ্চতম শাখা থেকে উত্তর আসে, “আমরা চতুর্দশ দেবতা - হর (শঙ্কর), উমা (শঙ্করী), হরি (বিষ্ণু), মা (লক্ষ্মী), বাণী (সরস্বতী), কুমার (কার্তিকেয়), গণপা (গণেশ), বিধি (ব্রহ্মা), ক্ষ্না (পৃথিবী), অব্ধি (সমুদ্র), ভাগীরথী (গঙ্গা), শিখি (অগ্নি), কামদেব (প্রদ্যুম্ন) ও হিমাদ্রি (হিমালয়)।”

​“বেশ। কী চাও?”

​“মুক্তি চাই, রাজমহিষী। এই পাষণ্ড ষাঁড়ের কবল থেকে। তাড়া খেয়ে এই শিমুলগাছে আশ্রয় নিয়েছি। আজ সাতদিন অভুক্ত বসে আছি গাছে।”

​রানিমা ভাবলেন, তাই তো। গত সাতদিন তো ঘোর বর্ষার কারণে নদীঘাটে আসতে পারিনি। নইলে অনেক আগেই চোখে পড়ত এ অঘটন। কিন্তু এই সাতদিনে এ-সংবাদ রাজদরবার অবধি পৌঁছল না, সেও এক আশ্চর্য বটে। মুখে বললেন, “সে কী! তোমরা তো নিজেদের দেবতা বলে পরিচয় দিলে। তবে নিজেরাই এর বিহিত করলে না যে বড়ো! কোথায় তোমাদের দৈববল?”

​দেবতাদের গলায় আক্ষেপ। জবাব আসে, “আমরা বর্তমানে অভিশাপগ্রস্ত রয়েছি, রাজরানি। এক্ষেত্রে আমাদের কোনও দৈববলই কাজে আসবে না। আপনি সাধ্বী নারী। এক আপনিই পারেন আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে।”

​হীরাবতী মুহূর্তকাল ভাবলেন। বললেন, “বেশ। তবে তাই হোক। বলো, কী উপায়ে আমি রক্ষা করতে পারি তোমাদের। যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমি।”

​দেবতাগণ সমস্বরে বলে ওঠেন, “আপনি আপনার রিয়া (বক্ষবন্ধনী) ষাঁড়ের চোখে বুলিয়ে তার পিঠে ফেলে দিন। তবেই সে শান্ত হবে; আমরাও গাছ থেকে নেমে আসতে পারব।”

​হীরাবতী উপায় শুনে তৎক্ষণাৎ রাজবাড়ি খবর পাঠিয়ে নিজের একখানা রিয়া, একদল সেপাই-সান্ত্রী আর জনাকতক রাজভৃত্য আনালেন। কিন্তু এই দৈত্যাকার ষাঁড়ের বিকট চেহারা দেখেই সেপাইরা পিছিয়ে এল সাত পা। কেউই ওই যমদূতের কাছে রিয়া হাতে এগোতে সাহস পাচ্ছে না।

​শেষপর্যন্ত এগিয়ে এল বৃদ্ধ এক রাজভৃত্য। বলে, 


“রানিমা, আমার দিন তো এমনিতেই ফুরিয়ে এল। আমিই চেষ্টা করে দেখি বরং, ষাঁড়ের গুঁতোয় প্রাণ গেলেও ক্ষতিবৃদ্ধি বিশেষ কিছু নেই।”

​এই বলে সে ষাঁড়ের সম্মুখে অবতীর্ণ হল। ক্ষ্যাপা ষাঁড়ও মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে তেড়ে এল শিং বাগিয়ে। বৃদ্ধ বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে না গিয়ে রানিমার রিয়াখানা বুলিয়ে দেয় ষাঁড়ের চোখে। মুহূর্তের অপেক্ষা। অচিরেই ষাঁড়ের কেমন এক ভাবান্তর উপস্থিত হল। সেই সুযোগে বৃদ্ধ তড়িৎগতিতে বাকি কাজটুকু সেরে ফেলে। রিয়াখানা ফেলে দেয় ষাঁড়ের পিঠে। নিমেষে শান্ত হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে ষাঁড়। সৈনিকেরা তৈরিই ছিল। অমনি দড়িদড়া জড়িয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তাকে। দেবতাদের নির্দেশে গাছের সঙ্গে শিংদুটো বেঁধে বলি দেওয়া হয় তাকে। চৌদ্দ দেবতারা নির্বিঘ্নে নেমে এলেন গাছ থেকে। তারপর বলিদত্ত ষাঁড়ের রক্ত পান করে শান্ত ও তৃপ্ত হলেন প্রত্যেকে।

​রাজমহিষী হীরাবতী চৌদ্দ দেবতাকে রাজযোগ্য আড়ম্বরে রাজপ্রাসাদে প্রতিষ্ঠা করলেন। রাজমহিষী নির্মিত মন্দিরে নিত্য পূজা পেতে লাগলেন চৌদ্দ দেবতা।

​রাজকুমার ত্রিলোচন তখন সদ্য কিশোর। নতুন দেবতাদের নিয়ে তার কৌতূহলের অন্ত নেই। মায়ের চোখের আড়াল হলেই সে চলে যায় নতুন মন্দিরে। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে মায়ের কোল ঘেঁষে বসে। রানি হীরাবতী একসময় লক্ষ করেন যে তাঁর নয়নের মণি রাজকুমারের শরীরগতিক দিন দিন যেন কেমন হয়ে আসছে। নতুন মন্দির থেকে বেরোলে তার চোখমুখ অত্যন্ত পাংশু দেখায়।

​হীরাবতীর সন্দেহ হল। কোনও অঘটন ঘটে চলছে না তো তাঁর অলক্ষ্যে? তক্কে তক্কে রইলেন। রাজকুমার মন্দিরে ঢোকার সামান্য পরেই তিনি একদিন মন্দিরের দরজার ফাঁকে চোখ রাখলেন। যা দেখলেন, এর চেয়ে ভয়ংকর বুঝি দুঃস্বপ্নও হয় না। দেখেন, দেবতাদের সিংহাসনের সামনে পড়ে এক মুণ্ডুকাটা পাঁঠা। তার ধড় থেকে একে একে রক্ত পান করছেন চৌদ্দ দেবতা। তৃপ্ত হতেই পাঁঠার কাটা মুণ্ডু পুনরায় জোড়া লেগে গেল আর প্রাণ ফিরে পেয়ে সে ধীরে ধীরে কিশোর ত্রিলোচনের অবয়ব ধারণ করল। রানিমার বুঝতে বাকি রইল না কিছুই। তিনি সজোরে দরজা খুলে দেবতাদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর তেজোদীপ্ত দৃষ্টির সামনে চতুর্দশ দেবতা অনুতাপে দগ্ধ হতে লাগলেন। রানিমা হুঙ্কার দিলেন, “কৃতঘ্ন দেবতা সব! এই তোদের প্রাণরক্ষার প্রতিদান? শেষে কিনা আমারই বুকের ধনের রক্তে লোভ জেগেছে তোদের!”

​দেবতারা পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন। বললেন, “শান্ত হন, রাজমহিষী। অকৃতজ্ঞ আমরা কেউই নই। এ ভবিতব্য। আমরা অভিশাপগ্রস্ত ছিলাম এতদিন। আজ আমাদের শাপমুক্তি ঘটল। শিমুলতলে আপনি স্বয়ং, আর এই মন্দিরে রাজকুমার আমাদের সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আমরা আপনাদের কাছে চিরঋণী রইলাম। তবে একটা কথা, রাজরানি। আমাদের নিত্য ভোগে পঞ্চব্যঞ্জন ব্যতীতও বলিদত্ত রক্তের অবশ্য প্রয়োজন। আমরা আপনার নিকট সে রক্তের স্থায়ী ব্যবস্থার আশা করছি।”

​দিনটা ছিল আষাঢ় মাসের শুক্লাষ্টমী। সেদিন থেকে প্রচলিত হল চতুর্দশ দেবতার পূজনবিধিতে নিয়মিত ছাগবলির রীতি। সে থেকে আজ অবধি চতুর্দশ দেবতার মন্দিরে সে-প্রথা প্রচলিত।

​আর প্রতিবছর আষাঢ়ের শুক্লাষ্টমী তিথিতে শুরু হয়ে সাতদিন ধরে চলে খারচি পূজা নামে চতুর্দশ দেবতার এক বিশেষ পূজনরীতি। এই সাতদিন চলে পুণ্যার্থীদের এক মহামিলন মেলা।

_____

(ত্রিপুরদেশের লোককাহিনি)



অলঙ্করণ : স্বর্ণদ্বীপ চৌধুরী

1 comment: