বই কথা কও


বই কথা কও
সুস্মিতা কুণ্ডু
*************************
“চুক আর গেক”
লেখক: আর্কাদি গাইদার 
(রাদুগা প্রকাশন, মস্কো)
চিত্রাঙ্কন: দ. দুবিন্‍‌স্কি
অনুবাদ: শঙ্কর রায়
(প্রগতি প্রকাশন, ১৯৮০)
সম্পাদনা: ননী ভৌমিক
*************************

বন্ধুরা নিশ্চয়ই জানো কিশলয়-এর এই সংখ্যার বিষয় ছুটি ছুটি। তাহলে বই কথা কও-বিভাগে কোন বইয়ের গল্প শোনাই বলো তো তোমাদের? আমার সেই ছোটোবেলার স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা একটা বইয়ের গল্প শোনাই তবে। সেই বইয়ে আছে দুই ভাইয়ের গল্প যারা বাবার সঙ্গে ছুটি কাটাবে বলে অনেকদূরের পথ পাড়ি দিয়েছিল। একা একা নয় অবশ্য, মায়ের সঙ্গেই গিয়েছিল সেই দুই ভাই, চুক আর গেক। হ্যাঁ এই বইটির নামই হল ‘চুক আর গেক’... দুই ভাইয়ের গল্প। 

ছোটোবেলার বইয়ের আলমারির অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকত সোভিয়েত রাশিয়ার অনেক গল্পের বাংলা অনুবাদের বই। সে এক আশ্চর্য দুনিয়া, মায়াবী জগৎ সদ্য পড়তে শেখা এক শিশুর কাছে। সহজ সরল অনুবাদ, মনমাতানো ছবি, শিশুকিশোর সাহিত্যের অফুরান ভাণ্ডার। 

গল্পটা ছোট্ট করে শোনাই তবে এসো। 

চুক আর গেক দুই ভাই তাদের মায়ের সাথে থাকে মস্কোয়,  যে শহরের মিনারের মাথায় দিন রাত জ্বল জ্বল করে লাল তারা। আর তাদের বাবা থাকে অনেক অনেএএক দূরে... তাইগায়। বাবা যে ভূতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বিজ্ঞানী সেখানে। ট্রেনে চেপে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে তার পর আবার বরফের ওপর দিয়ে স্লেজগাড়ি চেপে যেতে হয় তাইগায়। সে কী আর মুখের কথা! তাই যখন বাবার চিঠি এল যে বাবা আসতে পারবে না ছুটিতে, বরং চুক আর গেককে নিয়ে মাকে যেতে বলেছে তাইগায়, দুই ভাই তো তখন আহ্লাদে আটখানা! 

তাইগা কত বিপজ্জনক জায়গা, বরফে মোড়া, ঘন জঙ্গলে ঢাকা, ইয়া বড় বড় ভাল্লুকের আস্তানা। চুক আর গেক তো প্রস্তুতি নিতেই ব্যস্ত! একজন লাঠির মাথায় পেরেক দিয়ে বর্শা বানায় তো একজন রান্নাঘরের ছুরি দিয়ে অস্ত্রের অভাব মেটায়। তারই মধ্যে দুই ভাইয়ে লাগল খুনসুটি ঝগড়া আর সেই গোলমালে একটা জরুরী টেলিগ্রাম হারিয়ে ফেলল ভুল করে দু’জন। যদিও ঘটনাটা মায়ের কান অব্দি পৌঁছলনা কিন্তু তার জন্য যে কী ভোগান্তি হল সেই গল্পয় আসছি একটু পরেই। 

তার আগে তো রয়েছে লম্বা একটা ট্রেনযাত্রা। বরফের বুক চিরে ছুটে যাওয়া ট্রেন। বাইরের বরফের রাজ্য বিছিয়ে আছে চাঁদের আলো। গেকের মত ছোট্ট খোকাও জানলার শার্সিতে নাক ঠেকিয়ে সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্যে হারিয়ে যায়। বাইরের টুকরো দৃশ্যের পেছনে থেকে যায় কত কাহিনী। ওদিকে চুক অবশ্য কামরার বাকি যাত্রীদের সাথে ভাবসাব জমিয়ে অনেক উপহার জমিয়ে ফেলে। 

গল্পের এই জায়গাটায় বড্ড নিজেকে খুঁজে পেতাম গেকের মধ্যে দিয়ে। দূরপাল্লার ট্রেনে চেপে পাড়ি দেওয়ার সময় চোখে পড়ত কত দৃশ্য, কত মানুষ। তারা কে, তারা কী করে, কীই বা তাদের নাম, কোনওকিছুই জানা সম্ভব নয় ছুটন্ত ট্রেনের জানলার এপার থেকে। একমাত্র কল্পনার আশ্রয় নেওয়াই উপায় সেই দৃশ্যগুলোর সাথে আলাপ জমানোর। ঠিক যেমন চুক আর গেকের মস্কো শহরের কল্পনা মিলিয়ে নিতাম আরেকটা মোটাসোটা বইয়ের পাতা থেকে। সেই বইটার নামই ছিল ‘মস্কো’, বই নয় পিকচার বুক বলাই ভালো। বিশাল বড় আকারে মোটা বইটার পাতার পর পাতা জুড়ে চকচকে মসৃণ ছবি, মস্কোর অলিগলির। মস্কোর বৈভব, সৌন্দর্য, মানুষেরা আর আমার সবচেয়ে প্রিয় বরফের ছবি। ফ্রিজ ছাড়াও যে আরও কোথাও এরকম স্তরে স্তরে বরফ বিছিয়ে থাকতে পারে সেই ধারনাই হয়েছিল মস্কোর ওই ছবিগুলো দেখে। 

এই দেখো! এক বইয়ের গল্প বলতে বলতে আরেক বইয়ের পাতায় চলে গেছি! ফিরে আসি চুক আর গেকের কাছে আবার। ওদের দিনকয়েক লম্বা ট্রেনযাত্রা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। নানা দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে, ট্রেনের কামরাগুলোর গলাবাজী গান শুনে শেষমেষ পৌঁছল ছোট্ট একটা স্টেশনে। সেখান থেকে স্লেজে করে যেতে হবে আরও ষাট পঁয়ষট্টি মাইল পথ। কিন্তু এবারেই হল মুশকিল। বাবা তো কই স্লেজ পাঠায়নি! বহু কষ্টে এক গাড়োয়ানকে রাজী করিয়ে মা আর দুই ছেলে যাও বা স্লেজে করে অনেকটা পথ পাড়ি দিল। মাঝে রাত কাটালো গাড়োয়ানদের ‘ইস্টিশনে’। অবশেষে পরের দিন পৌঁছল ‘তিন নম্বর ভূতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র’-তে, সেখানে বাবা আর বাবার টিমের কেউই নেই। গাড়োয়ান তো ওদেরকে গবেষণাকেন্দ্রের দারোয়ানের ঘরে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। 

এদিকে দারোয়ানমশাই তো ফিরে এসে রেগে লাল! বড়সাহেব মানে চুক আর গেকের বাবার নির্দেশ অনুসারে সে নিজে টেলিগ্রাম করেছিল মস্কোয় যে বড়সাহেবের পরিবার যেন কদিন পরে আসে এখানে। বড়সাহেবের গোটা টিম গেছে আল্‌কারাশ খাদে, ফিরবে দশদিন পর। এবারে ফাঁস হল সেই হারানো টেলিগ্রামের রহস্য। মা তো ভারি রাগ করল আর দুই ভাই জুড়ল কান্না। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। এবার কী উপায়? 

উপায় আবার কী? চুক আর গেকের মত দুই ভাইয়ের নতুন বছরের উৎসব খারাপ কাটবে তা আবার হয় নাকি? দারোয়ানমশাই যতই রাগী হোক আসলে মনটা তো তার খুব ভালো। তাই পোষা কুকুরটিকে সঙ্গে নিয়ে নিজে গিয়ে, খবর দিয়ে, বড়সাহেবের শিগগিরই বাড়ি ফেরার বন্দোবস্ত করল। আর ঠিক বছরের শেষ দিনটাতেই ফিরে এল চুক আর গেকের বাবা আর গোটা টিম। সক্কলে একসাথে পালন করল উৎসব। হাতে গড়া মোমবাতি, তেড়াব্যাঁকা পুতুল তাই দিয়েই সাজানো হল ঝাউগাছ। তাতেই সব্বাই খুশি! উৎসব ছুটি এসবের আসল মজা তো পরিবারের সাথে সময় কাটানোতেই আসে, তাই না? ও হ্যাঁ! গেক সেদিন ভারি সুন্দর গানও গেয়েছিল কিন্তু। 

আরও অনেক মজার  মজার কাণ্ড ঘটিয়েছিল সারা বই জুড়ে দুই ভাই। সেগুলো জানতে হলে শিগগির পড়ে ফেলতে হবে তো বইটা, তাই না ছোট্ট বন্ধুরা? 

সঙ্গের ছবিটা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে দিলাম। ইচ্ছে ছিল আমার বইয়ের আলমারির সেই পুরনো বইখানার হলদে হয়ে আসা মলাটটার ছবি দেব, কিন্তু আমিও এখন আমার সেই বইগুলোর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আছি কিনা। হয়ত আগামী ছুটিতে আমিও গিয়ে দেখা পাব আমার শৈশবের গন্ধমাখা সেই বইটার, যেটার পাতা ছুঁলেই কানে ভেসে আসত সূদুর ‘মস্কোর ক্রেমলিনের স্পাস্কায়া মিনার’-এর লাল তারার নিচের ঘড়িটা থেকে ভেসে আসা ঘন্টার শব্দ,

“তির-লিল্-লিলি দং
তির-লিল্-লিলি দং“

(সমাপ্ত)


No comments:

Post a Comment