গল্পের ঝুলি : তেরোর গেরোয় : দেবদত্তা ব‍্যানার্জী




তেরো সংখ‍্যাটাকে সবাই কেন অপয়া বলে অনয়া বোঝে না। একটা নির্দোষ সংখ‍্যার উপর সকলের এই রাগের কারণ ওর ছোট্ট মাথায় ঢোকে না। কিন্তু এই তেরো সংখ‍্যাটা যেন অনয়ার জীবনে একটা অভিশাপ। ছোটকাকুর বৌভাতের দিন পড়েছিল তেরো তারিখ। তাই ঠাম্মা সেদিন অনুষ্ঠান করতে দেয়নি। চোদ্দ তারিখ হয়েছিল বৌভাতের অনুষ্ঠান। তাতে অবশ‍্য একটা দিন বাড়তি পাওনা হয়ে বেশ আনন্দ হয়েছিল অনয়ার। 

তবে সেবার পূজার ছুটিতে ওদের দার্জিলিং ঘুরতে যাওয়া বানচাল হয়ে গিয়েছিল এই তেরোর গেরোয়। চারমাস আগে ভোরবেলা লাইনে দাঁড়িয়ে বাবাই যখন টিকিট কেটেছিল, ওটা যে তেরো তারিখের টিকিট, আর ঠাম্মা যে কাউকে ঐ দিন যেতে দেবে না বাবাই বুঝতেই পারেনি। আসলে ছুটিটা তো ঐ দিন থেকেই পড়েছিল। ঠাম্মা ঘুরতে যাওয়ার পনেরো দিন আগে যেই শুনল টিকিট তেরো তারিখের, বলে দিলো যাওয়া হবে না। দাদু, মা, ছোট কাকু নতুন কাকি সবাই চুপ। ঠাম্মার এই তেরো সংখ‍্যার প্রতি বিরক্তির কারণ সবাই জানে। অনয়ার খুব রাগ হয়েছিল সেবার। 

আজ আবার ক্লাস টেস্টে অঙ্কে তেরো পেয়েছে ও। বাড়ি ফিরলেই কপালে মায়ের বকা নাচছে। অনয়ার জন্মদিনও তেরো তারিখ, তার উপর শনিবার অমাবস‍্যায় জন্ম বলে ঠাম্মা মুখ কালো করে হাসপাতালে দাঁঁড়িয়েই নাকি অপয়া বলেছিল ওকে। বাবাই তখন আদর করে সেটা বদলে ওর নাম রেখেছিল অনয়া।একমাত্র বাবাই ওকে ভালোবাসে। কিন্তু বাবাই তো শহরে থাকে, মাসে মাত্র একবার আসে।
পরশু বাবাই আসবে আর অনয়ার জন‍্য কত কী নিয়ে আসবে!


বাড়ি ফেরার পথে কালো বেড়ালটাকে আদর করে বাঁঁচিয়ে রাখা টিফিনটা খাইয়ে দেয় অনয়া। বেচারা বেড়ালটা কালো বলে ওকেও সবাই অপয়া বলে দূর দূর করে সবসময়। অথচ মিতিনদের লেজ মোটা হলদে হুলোটা সবার বাড়ি চুরি করে খেয়েও কত আদর পায়। তাই তো এই মেনিটাকে ওর নিজের সমব‍্যথী মনে হয়। রোজ বিকেলের দুধটা মায়ের চোখ বাঁচিয়ে মেনিকে খাওয়ায় ও। ওর ঐ বিড়ালপ্রীতিও ঠাম্মার চক্ষুশূল। কালো বিড়াল নাকি অলক্ষ্মী। এসব কথা সারাক্ষণ বলে চলেছে ঠাম্মা। বিড়ালটা মাঝে মাঝে ওর পড়ার ঘরের জানালায় এসে মিয়াও মিয়াও বলে ডাকে। ঠাম্মার কানে গেলেই শুরু হয় কীর্তন। 

''বেড়াল কাঁঁদা ভালো নয়, অলুক্ষুণে কালো বেড়াল...'' আরো কত কী বলতে থাকে।

গত মাসে ওর পড়ার ঘরে ইঁঁদুর হয়েছিল খুব। বইপত্র কেটে দিয়েছে দু'বার। মেনি কয়েকটা ইঁদুর মেরেছিল বলে ঠাম্মার কী চিৎকার! গনেশের বাহন হল ইঁঁদুর। এরাও নাকি ঘরের লক্ষ্মী। দাদুর ব‍্যবসার লক্ষ্মী। অথচ স্কুলের মিস বলে ইঁদুর খুব নোংরা, প্লেগের জীবাণু বহন করে।কিন্তু এদের কে বোঝাবে!


সেদিন বাড়ি ফিরেই অনয়া দেখে হুলুস্থুলু ব‍্যাপার, ওদের গৃহদেবতা লক্ষ্মীদেবীর গলার সোনার হার চুরি গেছে। সারা বাড়ি তোলপাড় হচ্ছে। ছোটকাকু আর নতুন কাম্মা এক সপ্তাহ আগেই ফিরে গেছে কলকাতায়, কাজের জায়গায়। ওরাও থেকে থেকে ফোন করছে। মিনুদিদি আর কণিকামাসি এ বাড়িতে কাজ করে। বাইরের লোক বলতে ওরাই একমাত্র তিনতলায় ছাদের ঘরে যায়। আর তো বাইরের কেউ ঢোকে না।ওদের বারবার করে জিজ্ঞেস করছে ঠাম্মা আর মা। মিনুদিদি পা ছড়িয়ে দেওয়ালে মাথা ঠুকে কাঁঁদছে আর বলছে, ''শেষে চুরির অপবাদ! ও মা লক্ষ্মী, দেখো গো মা! এই বাড়িতে এত খাটি, কুটোটি নিই নি গো মা, তাতে এখন এরা এসব বলছে!"
কণিকামাসি গম্ভীর হয়ে বলছে, ''শেষ বয়সে শেষে তোমরা আমাদের চুরির দায়ে জেলে দেবে? এ-ও ছিল কপালে!''


দাদু গম্ভীর হয়ে পায়চারী করছে আর বলছে, ''বাসি ফুলের সঙ্গে ফেলে দাওনি তো? খুঁজে দেখো আবার।''
মা বলছে, ''সব ফুল নেড়ে দেখে এসেছি বাবা। কোথাও নেই। প্রায় দু'ভরির ভারি হার। গতকালও মায়ের গলায় ছিল।''


অনয়ার অঙ্ক খাতার কথা আর বলা হয় না। তাড়াতাড়ি খেয়ে ও নিজের ঘরে ঢুকে যায়। সন্ধ‍্যায়ও থমথমে পরিবেশ। দাদু বাধ‍্য হয়ে থানায় জানিয়েছে। দুজন মোটা গোঁফওয়ালা পুলিশ এসে মিনুদিদি আর কণিকামাসির সঙ্গে কী সব কথা বলছে থেকে থেকেই। রাতে আজ একাই পড়াশোনা করল অনয়া। শুয়ে শুয়ে ভাবে আজ তো তেরো তারিখ নয়। তবে কেন এমন হলো!
পরদিন স্কুল যেতে হল ম‍্যাগি খেয়ে। কণিকামাসি কাজে আসেনি। হয়তো আর আসবে না। মিনুদিদি এ বাড়িতেই থাকে। সে রাঁধতে জানে না। আজ টিফিনেও জ‍্যাম ব্রেড। 


বিকেলে বাড়ি ফিরেই অনয়া বোঝে এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ঠাম্মা থেকে থেকেই ''মা গো , পাপ নিও না। এ কী অমঙ্গল হল গো!'' বলে সুর তুলছে। 

কখনো বলছে, ''সোনা হারানো খুব বাজে। হবে না! এক অপয়া রয়েছে ঘরে, এ ঘরে কি লক্ষ্মী থাকবে?'' 

অনয়া বোঝে না এতে তার দোষ কোথায়! দাদু আজ দোকান খোলেনি। মায়ের মুখ গম্ভীর, বাবাই নাকি দুপুরের পর আর ফোন তুলছে না। ফোন লাগছেই না।

মিনুদিদি বিকেলের দুধটা ওর টেবিলে রেখে বলে যায়, ''আমার হয়েছে যত জ্বালা, মাস পুরলে চলে যাবো আমিও কাজ ছেড়ে।''


বাটিটায় দুধটা ঢেলে পা টিপে টিপে অনয়া বাগানে বেরিয়ে আসে। পিছনের ভাঙাচোরা আবর্জনা রাখার ঘরটার পাশেই মেনি থাকে এসময়। কিন্তু আজ নেই। দুধটা ফেলে রাখলে হুলো খেয়ে যাবে। তাই বাটি হাতেই ও বাগানে খুঁজতে বার হয়। মৃদু স্বরে মেনিকে ডাকতেই সে মিয়াও করে সাড়া দেয় গোলাপগাছের ঝোপের নিচ থেকে। বাটি নামিয়ে চুকচুক আওয়াজ করে অনয়া। কিন্তু মেনি কী যেন করতে ব‍্যস্ত! মাটি খুঁড়ে কী করছে ও? 


অনয়া এগিয়ে যায়। গোলাপঝাড়ের নিচের নরম মাটি দু পায়ে খুঁড়ছে মেনি। ওর কি শরীর খারাপ? শরীর খারাপ হলে কচি দুব্বো খায় ওরা, মা বলেছিল। গোলাপঝাড়ের নিচে দুব্বোঘাস আছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে অনয়া দেখে মেনিটা একটা কী যেন টেনে বার করতে চাইছে, চকচক করছে জিনিসটা। 

আরে, এই তো সেই হারটা! তাড়াতাড়ি মেনির সঙ্গে দু'হাতে মাটি খুঁড়ে হারটা খুঁজে পায় অনয়া। লাফাতে লাফাতে দুধের বাটি ভুলে ঘরে ছোটে ও।


আর তখনি একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় বাড়ির সামনে। অনয়া দেখে বাবাইও চলে এসেছে। ওর আর খুশির সীমা নেই। ওর চিৎকারে মা ঠাম্মা সবাই বাইরে বেরিয়ে এসেছে। মা তো কেঁদেই ফেলেছে বাবাইকে দেখে।


''আজই চলে এলাম, বুঝলে! কী সব চুরি হয়েছে বললে। তাই আর কি!'' বাবাই অনয়াকে কোলে তুলে নেয়।
''এই দেখো, চোরাই মাল। আর কে খুঁজে দিয়েছে জানো? আমার মেনি, ঐ কালো বেড়ালটা।'' 


অনয়ার হাতে মাটি মাখা হারটা দেখে সবাই অবাক। 

মুহূর্তে বাড়ির পরিবেশ বদলে যায়। 


আপাতত মেনিকে ড্রইং রুমের মেঝেতে বসিয়ে আদর করে দুধ খাওয়াচ্ছে ঠাম্মা। আর বাবাইয়ের কোলে বসে মেনির হার খুঁজে দেওয়ার গল্প করছে অনয়া। দরজার পাশে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে মিনুদিদি। ঠাকুরের বাসন নামিয়ে রোজ বাগানে দুব্বো আনতে যায় ও বাসন মাজার জন‍্য। সে সময় হারটা বাগানে পুঁতে এসেছিল, কাজ ছেড়ে দেবে বলে গান গাইছিল। সময় সুযোগ বুঝে তুলে নিত। খবর পেয়ে কণিকামাসিও এসেছে ফিরে। এত বছরের পুরানো কাজ, ভালো মাইনে, কেউ কি ছাড়তে চায়? ছোটকাকুদের ফোনে জানানো হয়েছে সব।

হঠাৎ বাবাই বলে ওঠে, ''যে মেনিকে অপয়া বলতে সে-ই কিন্তু আজ হিরো। ওর জন‍্যই হারটা পাওয়া গেলো। আর আজকের বাংলা তারিখটাও কিন্তু তেরো। আজ কিন্তু খুব ভালো দিন। আর আমার মেয়েকে তোমরা তেরোর খোঁটা দেবে না বলে দিলাম।ওর আর মেনির জন‍্য আজ লক্ষ্মীর হার ফেরৎ এলো।''


ঠাম্মা আজ প্রথমবার অনয়াকে আদর করে বলে, ''ও তো এবাড়ির জ‍্যান্ত মা লক্ষ্মী।'' 


মিনু হঠাৎ কেঁদে এসে বাবাইয়ের পা জড়িয়ে বলে, ''বড়দা, লোভের বশে করে ফেলেছি গো। আমার কাজটা খেয়োনি গো। আমি আর এসব করবোনি গো। ও বড়মা তোমার লক্ষ্মীর দিব‍্যি বলছি গো। ''

দাদু বলে, ''ঠিক আছে, ঠিক আছে। আবার দিব‍্যি! কুসংস্কারগুলো আজ থেকে বাতিল। সেই আনন্দে একটু মিষ্টি নিয়ে আয় তো মিনু।ডায়বেটিস আজ আর মানছি না।'' 


সবাই হেসে ওঠে। আর তখনি অনয়ার মনে পড়ে অঙ্কখাতার নম্বরটা বাড়িতে বলাই হয়নি। তবে বাবাই যখন আছে চিন্তা নেই। মাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে চুপি চুপি কানে কানে বাবাইকে বলতেই বাবাই বলে, 

''কুড়িতে তেরো তো অনেক নম্বর রে। আমিও এত নম্বর পেতাম না ছোটবেলায়। আজ তো মিষ্টি আসবেই সবার জন‍্য।''

আনন্দে ঝলমল করে ওঠে অনয়ার মুখ। আর তেরোকে কেউ খারাপ বলতে পারবে না। মেনিও ওদের ঘরে ঢোকার ছাড়পত্র পেয়ে গেলো আজ থেকে। কী মজা!! কালো মেনিটা কী বুঝল কে জানে, দুধ শেষ করে ঠোঁটটা চেটেই ডেকে উঠল "মিয়াও মিয়াও"।



অলঙ্করণ : আবির

No comments:

Post a Comment