গল্পের ঝুলি : পশুরাজ সিংহবর্মা : ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়



রাজ্যটা নেহাত ছোট নয়। সারা পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে বিশাল পর্বতমালা। আর উত্তর থেকে দক্ষিণ ঘিরে রয়েছে বিশাল সমুদ্র। সমুদ্র পেরিয়ে কাউকে যদি পাহাড়ের দিকে যেতে হয় তবে পেরোতে হবে অনেক কিছু। যেমন বিশাল এক দুর্ভেদ্য গহন অরণ্য। পেরোতে হবে সবুজ মাঠ আর ফাঁকা জমি। অনেক নদীনালা যেগুলো পাহাড় থেকে তৈরি হয়ে সাগরের দিকে চলে গেছে পেরোতে হবে সেগুলোও। আবার নদী তো শুধু একদিকেই যায়নি। উত্তর থেকে পূর্ব অর্ধ-চন্দ্রাকার পথে সরু সরু কেঁচোর মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে সমুদ্রের দিকে।

চারিদিক শুধু সবুজ আর সবুজে মোড়া এক রাজ্য। এই রাজ্যের রাজা প্রবল প্রতাপান্বিত সিংহবর্মা। যার এক হুংকারে সাগরে ঢেউ উঠে যায় চল্লিশ থেকে চারশোটা। পাহাড়ের ক’টা পাথর ধ্বসে পড়ে যায় তা অবশ্য গুনে দেখেনি কেউ। তবে জঙ্গলে ঝড় ওঠে বেশ বড়সড়। সমস্ত পশুরা থরথর করে কাঁপতে থাকে।

সিংহবর্মার নিজের সংসারে আছে তার বৌ সিংহী আর দুটো ছোট ছোট বাচ্চা। বাচ্চাদুটোকে দেখে একদিন তো এক বনবিড়ালের মা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। আগে সেই গল্পই বলি তবে।

বনবিড়ালরা বেশ বড়সড় হয়। অনেকটা সিংহছানার মত দেখতে। একদিন বনবিড়ালের দুটো বাচ্চা হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল মানে দুপুরে খেয়েদেয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। সারাদিন কেটে গিয়ে সন্ধের মুখে পশুরাজের গুহার কাছে গিয়ে বনবিড়াল তো অবাক! দেখে গুহার কাছে তার চার চারটে বাচ্চা দিব্বি খেলা করছে। তার দুটো বাচ্চা কী করে চারটে হয়ে গেল বুঝতে পারে না।

অনেক সময় চোখের পাতা একটু এদিক সেদিক হলে সব কিছু দুটো দুটো মনে হয়। নিজের চোখের পাতা একটু একটা গাছে ঘষে নিয়ে দেখল, না, দুজন তো নয়, চারজনই তো বটে! একটু কাছে যেতে ভুল ভাঙল। দুটো তার নিজের বাচ্চা বটে, তবে আর দুটো তো পশুরাজের। ওরা একসঙ্গে খেলা করছে। আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের মা সিংহী মিটিমিটি হাসছে।

বেশ একটু দূর থেকেই নিজের বাচ্চাদের ডাকল বনবিড়াল। সিংহী বলল, "দূর থেকে কেন গো বনবিড়াল? কাছে এস না! দেখে যাও তোমার দুই বাচ্চা আমার দুই বাচ্চার সঙ্গে কেমন খেলা করছে।"

বনবিড়ালের একটু ভয় ভয় করছিল। এসব রাজা-রানিদের বেশি কাছে যাওয়া ঠিক নয়। কখন কী ভুল করে ফেলবে আর গর্দান চলে যাবে। মহারানি ঘ্যাঁক করে তেড়ে এসে তার ঘাড় কামড়ে ধরবে। গলার নলি চিরে দিয়ে খেয়ে ফেলবে। তবে সিংহরা রাজার জাত তাই এরা এত ছোট পশু খেতে ভালবাসে না। তাই সচরাচর বিড়াল বনবিড়াল বা ছোটখাট আর জন্তুদের দিকে ফিরেও তাকায় না। তবে তাদের এই রানিমা বেশ ভালমানুষ। সকলের সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা কয়। দরকার না হলে কাউকে শিকার করে না।

বনবিড়াল বলল, "পেন্নাম হই রানিমা। না রানিমা। এখন আর খেলা দেখার সময় নেই। আর বাচ্চাদের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। নদী থেকে বড় বড় দুটো মাছ ওদের জন্যে ধরে এনেছি। ওরা জ্যান্ত মাছ খেতে খুব ভালবাসে। লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করে তারপর খায়। আমারও দেখতে খুব ভাল লাগে সেই খাওয়া।"

সেই থেকে মাঝে মাঝেই অবশ্য বনবিড়ালের বাচ্চারা সিংহছানাদের সঙ্গে খেলা করে। বাচ্চাদের অবশ্য বেশ সাবধান করে দিয়েছে সে, "এখন ছোট আছ খেলাধুলো করতে পারো। কিন্তু বড় হলে খবরদার। ওদের ছায়া পর্যন্ত মাড়াবে না বলে দিলুম।"

পশুরাজ সিংহবর্মার রাজত্বে অনেক প্রজা। আছে মহামন্ত্রী বাঘ, সেনাপতি হাতি, কোটাল ভালুক, গুপ্তচর শিয়াল। এছাড়াও আছে হরিণ, গন্ডার, বানর, কচ্ছপ, বেজি, বেড়াল, বুনো মোষ, খরগোশ, হায়না, নেকড়ে, সব পাখির দল, নদী পুকুর আর খালবিলের মাছ আর অন্য জলচরের দল।

সিংহবর্মা খুব সাহসী আর বীর রাজা। তার এমনই প্রতাপ যে বাঘে-হরিণে একঘাটে জল খায়। অপ্রয়োজনে কাউকে শিকার করা যাবে না। অকারণে কারোর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করা চলবে না।

এই রাজ্যের পশ্চিমে বিরাট পাহাড় তা আগেই বলেছি। সেই পাহাড়ের এক গুহায় বেশ রাজকীয় মর্যাদায় বাস করে পশুরাজ সিংহবর্মা। এই পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ওপারে কী আছে বা সাগর পেরিয়ে কোথায় যাওয়া যায় সেটা কিন্তু জানে না সে। একবার লাফ দিয়ে পাহাড় পেরোবার চেষ্টা করতে গিয়ে তার হাড়গোড় ভেঙ্গে যাওয়ার মতো হয়েছিল। তারপর থেকে সে আর চেষ্টা করেনি।

আর একবার সাগর পেরোনোর কথা মাথায় এসেছিল বটে। কিন্তু একটা লাফে যতদূর গেল তাতে তার মনে হয়েছিল এরকম হাজার হাজার লাফ দিয়েও সাগর পেরোনো যাবে না। বিরাট বড় বড় ঢেউ তাকে নিয়ে যেন ভলিবল খেলতে লাগল। ভাগ্যি ভাটা এসে পড়ল এ সময়। জল কমে গিয়ে বালিতে গাঁথা হয়ে গেল সে। অনেক কষ্টে উঠতে হল। পরে সে সিদ্ধান্ত নিল এই সাগরের কোনও শেষ নেই। সাগরের পারে কোনও দেশ নেই।

পাখিদের মধ্যে চিল, বাজপাখি আর ঈগল আকাশের সবচেয়ে উঁচু দিয়ে ওড়ে। কিন্তু অনেক উঁচু দিয়ে উড়লেও অনেক নিচুতে তারা দেখতে পায়। গুহার সামনে বিরাট বড় গাছের মাথায় এরা তিনজন মাঝে মাঝে বিশ্রাম করে। ওদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় সিংহবর্মার। বাজ বলল, "পশুরাজ, এই পাহাড়ের ওপারে আছে সব মানুষের দেশ। তারা সব ভয়ংকর। ওদের অনেক বড় বড় অস্ত্র আছে। ওরা আমাদের মত পশুদের সব ধরে ধরে একটা খোঁয়াড়ে পুরে পয়সা নিয়ে অন্য মানুষদের দেখায়। তারা আমাদের বন্দি অবস্থায় দেখে খুব মজা পায়।"

চিল বলল, "হ্যাঁ পশুরাজ, বাজ যা বলছে সব এক্কেবারে ঠিক। এই খোঁয়াড়টাকে ওরা নাকি চিড়িয়াখানা বলে।"

ঈগল বলল, "ওরা দুজন ঠিক কথা বলছে পশুরাজ। ওদের চিড়িয়াখানায় কে নেই বলুন? সিংহ, বাঘ, হাতি, গন্ডার, হরিণ, জিরাফ, জেব্রা আবার জলচরদের মধ্যে আছে কচ্ছপ, কুমির, সাপ এইসব।"

বেশ সুখে-শান্তিতেই চলছিল রাজ্যটা। এমন সময় সিংহবর্মার মাথায় একটা চিন্তা এল। মহামন্ত্রী বাঘকে ডেকে বলল, "আচ্ছা মহামন্ত্রী, এই সাগরটা কার? মানে এর রাজা কে? কাউকে তো দেখতে পাই না।"

বাঘ তো এত কিছু জানে না। গাঁইগুঁই করে বলল, "মনে হয় এই সমুদ্রের কোনও রাজা নেই পশুরাজ।"

"কিন্তু প্রজা তো আছে?"

"হ্যাঁ হ্যাঁ, কিন্তু সব আছে জলের ভেতর। ছোট প্রাণীর সঙ্গে বড় প্রাণীরাও আছে মহারাজ।"

"যেমন?"

"এই যেমন ধরুন শুশুক, হাঙ্গর, তিমি এইসব। আর কুমিরও আছে তবে সে তো আমাদের সঙ্গেও বাস করে। মানে এই রাজত্বে।"

"হ্যাঁ জল থেকে তো প্রায়ই উঠে আসে ডাঙ্গায় রোদ পোয়াতে।"

একটু ভেবে পশুরাজ বলল, "আচ্ছা মন্ত্রী এই সাগরের রাজত্ব কি দখল করা যায় না?"

"এতবড় জায়গা নিয়ে কী করবেন রাজামশাই? আর তাছাড়া জলের ভেতরে তো আমরা কানা মহারাজ। কিছুই তো দেখতে পাব না।"

সিংহবর্মা ভেবে ঘাড় নেড়ে বলল, "তা ঠিক। কিন্তু কিছুটাও যদি দখল করা যেত তো রাজ্যটা বেশ একটু বড় হত।"

মহামন্ত্রী বাঘও একটু ভাবল। তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, "তা ঠিক। চেষ্টা করে দেখাই যেতে পারে। সেনাপতির সঙ্গে কথা বলে দেখুন সে কী বলে।"

সেনাপতি হাতি কিন্তু বেঁকে বসল, "আমার এত বড় আর ভারী দেহটা আমি সাগরে ফেলতে পারব না মহারাজ। একবার বালিতে আটকে গেলে আর পা তুলতে পারব না। আমাকে কি ডুবিয়ে মারবেন মহারাজ?"

সে তো ঠিক। সিংহবর্মা খুব চিন্তায় পড়লেন। তবে কি সাগর দখল হবে না ছিটেফোঁটাও?

সমাধান করে দিল হাতিই। বলল, "একমাত্র কুমির পারে সাগরে ডুব গালতে। উভচর প্রাণী সে। জলেও থাকে আবার ডাঙ্গাতেও। জলে ওর ক্ষমতাও প্রচুর। হাঙ্গর আর তিমির সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বও আছে ভাল। সাগর দখল সে-ই করতে পারবে।"

সিংহবর্মা দুদিকে ঘাড় নেড়ে বলল, "না না এ ঠিক নয়। এমনভাবে করলে তো সে-ই সাগরের রাজা হয়ে যাবে। আমাকে যদি প্রজারাই না দেখতে পেল তো আমাকে মানবে কেন রাজা বলে?"

"কেন মহারাজ? আপনি সাগরেও যেতে পারেন।"

"যেতে পারি? কেমন করে? ওই বড় বড় ঢেউয়ে আমি তো সাঁতার কাটতে পারব না!"

"আহা আপনাকে সাগরে সাঁতার কাটতে কে বলল? আপনি থাকবেন কুমিরের পিঠে। সাগরের সেনাপতি বানিয়ে দিন কুমিরকে। তারপর তার পিঠে চেপে সাগর পরিদর্শন করবেন।"

শুনে খুব খুশি হল পশুরাজ সিংহবর্মা। কুমিরকে সাগর বিভাগের সেনাপতি করে দেওয়া হল। পরের দিন থেকে শুরু সাগর দখল অভিযান। একটা কুমিরের পিঠে পশুরাজ সিংহবর্মা। আর একটা কুমিরের পিঠে বাঘ। দুই কুমির মাঝখানে পাশাপাশি। তাছাড়াও সঙ্গে চলল আরও অনেক কুমিরের একটা দল। তারা সব রইল এই দুজনকে ঘিরে। যেমন রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতির পেছনে পেছনে অন্য সেনারা যায়।

সাগরের মজা হচ্ছে এই যে যত বড় বড় ঢেউ সব কিন্তু পাড়ের দিকে। একটু মাঝ বরাবর গেলে ঢেউ অনেক কমে যায়। একটু কষ্ট করে পাড়ের দিকটা কাটিয়ে মাঝামাঝি চলে গেল সবাই। কুমিরের পিঠে বসে সিংহের সে কী হাঁকডাক! জলের প্রাণীরা কখনও সিংহ দেখেনি। তারা তো খুব ভয় পেয়ে গেল। কুমির এই সুযোগে কচাকচ করে কিছু সমুদ্রের প্রাণী মুখে করে ধরে পিঠের সিংহকে ভেট দিতে লাগল। জলের প্রাণীরা তাতে আরও ভয় পেয়ে গেল।

সাগরের সেনাপতি কুমির তখন সব জলের প্রাণীদের বলল, "আমার পিঠে যিনি আছেন তিনি হলেন সমগ্র পশুসমাজের রাজা। উনি পশুরাজ সিংহবর্মা। আর আজ থেকে সাগরের সব প্রাণীদের রাজা হলেন। কী, তোমরা সব মানবে তো?"

সবাই সমস্বরে বলে উঠল, "রাজি রাজি। এতদিন তিমি ছিল আমাদের রাজা। কিন্তু আমরা তার কাছ ঘেঁষতেই পারতুম না। এবার থেকে পশুরাজ সিংহবর্মাকেই আমাদের রাজা বলে মানব। সব অভাব অভিযোগ জানাব।"

এদিকে বেশ কিছুদূর দিয়ে আসছিল একটা জাহাজ। তারা নানা দেশ থেকে পশু ধরে ধরে নিজেদের দেশে নিয়ে যায়। তারা এই দৃশ্যে অবাক হয়ে গেল। সাগরে কুমিরের পিঠে সিংহ, বাঘ। ভারি মজার তো।

ঘটনা মজার হলেও জাহাজের ক্যাপ্টেনের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এল। এই দ্বীপে মনে হচ্ছে আরও অনেক জন্তু জানোয়ার আছে। তারা জাহাজটাকে সেখানে রেখে পেছন পেছন একটা বোট পাঠিয়ে দিল। সঙ্গে অস্ত্র থাকলেও সে বলে দিল খুব দরকার না হলে যেন সেগুলো ব্যবহার না করা হয়। চুপি চুপি এক একটা করে জন্তু শিকার করে জাহাজে তুলতে হবে।

পরের দিন ভোরে উঠে গুহার বাইরে এসেছে সিংহবর্মা। বৌ সিংহী সাতসকালে একটা বুনো মোষ শিকার করে এনেছে। এবার চারজন মিলে খাওয়া হবে। তারপর পশুরাজ তার রাজ্য পরিদর্শনে বেরোবে।

এমন সময় গাছ থেকে কী একটা সড়সড় করে নেমে এল। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই সেটা জড়িয়ে নিল পশুরাজকে। আর জড়িয়ে নিয়ে একেবারে গাছের টঙে উঠে গেল। পশুরাজ একটা জালের খাঁচায় বন্দি হয়ে ঝুলতে লাগল গাছের ডালে।

এ তো ভারি বিপদ। এমন ঘটনা আজ পর্যন্ত কখনও দেখেনি কখনও। পশুরাজ সিংহবর্মার কাছে এ শুধু বিপদই নয়, চরম লজ্জা আর অপমানও বটে। বনের পশুরা আর মানতে চাইবে তাকে? তারা ভাববে এই জঙ্গলে তাদের রাজার চেয়েও শক্তিশালী আর একজন রয়েছে যে সিংহবর্মাকে এমন ভাবে বন্দি করার সাহস দেখাতে পারে।

তার গাঁক গাঁক আওয়াজে ভেতর থেকে তার বৌ আর ছেলেরা বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আশপাশ থেকে বেরিয়ে এল সব পশুর দল। আকাশ পথে উড়ে এল চিল, ঈগল আর বাজ। তারা সমস্বরে বলল, "হ্যাঁ হ্যাঁ এ জিনিস আমরা চিনি। এ তো একটা ফাঁদ। একে জাল বলে। কোনও দুষ্টু মানুষ নিশ্চয় এসেছে এখানে লুকিয়ে থেকে এই ফাঁদ পেতেছে আমাদের জন্যে।"

বাঘের হঠাৎ মনে পড়ল মাঝসমুদ্রে সেই জাহাজটার কথা। হালুম হুলুম করে বলল, "এ নিশ্চয় সেই শয়তানগুলোর কাজ।"

কার কাজ সে তো নাহয় আন্দাজ করা গেল। কিন্তু পশুরাজকে এখন মুক্তি দেওয়ার কী হবে? ইঁদুর দলপতি বলল, "মাটিতে থাকলে আমার বাহিনী এক্ষুনি সব কেটেকুটে রাজাকে মুক্তি দিতে পারত। কিন্তু এত উঁচু গাছে আমরা উঠব কী করে? তাছাড়া এ ফাঁদ আবার আকাশে ঝুলছে। আকাশে যারা ওড়ে এ তাদেরই কম্ম।"

চিল, বাজ, ঈগল সব জড়ো হল সেই গাছের ডালে। কিন্তু তাদের শত চেষ্টাতেও কাটা গেল না জাল। এত মোটা জাল কাটা তাদের পক্ষে খুব অসুবিধে।

রাজ্যের সব পশুপাখি এসে জড়ো হয়েছে। পশুরাজ স্বয়ং এতবড় এক বিপদে! তারা কি কেউ আর ঘরে বসে থাকতে পারে? কিন্তু তারাই বা আর কী করে? কয়েকটা বানর অনেক চেষ্টা করল দাঁত দিয়ে সেই জাল কাটতে, কিন্তু পারল না। দিনের শেষে তারা সব ফিরে গেল নিজের নিজের বাসায়। আর পশুরাজ সেই জালের মধ্যে কোনওমতে কুঁকড়ে সারাদিন কাটালো। দানা নেই, পানি নেই, নেই কোনও খাবার। সিংহীরও কিছু করার নেই। সে শুধু কেঁদেই গেল। গুহার ভেতরে আওয়াজ উঠল গম গম করে।

সেদিন তো গেলই, সে রাতও গেল। ভোরের দিকে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায় পশুরাজের একটু তন্দ্রা আসবে বোধহয়। এমন সময় সে শুনল গাছের ওপর থেকে কিছু যেন আওয়াজ হচ্ছে। কী যেন খসখস করে আওয়াজ। একটু ভয় পেল। কাল সারা রাত খুব কষ্ট গেছে তার। মনে কষ্ট। পশুদের রাজা হয়ে এ কী বেইজ্জতি। ভাবা যায়?

একটা ডালে পাতার আড়ালে চকচকে একটা ছুরি নিয়ে একজন বসে। একে ঠিক চিনেছে সিংহবর্মা। এটা একটা মানুষ। এই লোকটাই মনে হয় তাকে ফাঁদ পেতে ধরেছে। চুপি চুপি গাছের আড়ালে লুকিয়েছে অন্য পশুদের ভয়ে। কিন্তু লোকটার হাতে ছুরি কেন? নেহাতই আত্মরক্ষার জন্যে নাকি তাকে কেটে কেটে খাবে? মানুষ অনেক পশু মেরে খায় শুনেছে বটে সিংহবর্মা। তবে বাঘ সিংহ বা হাতি গন্ডার খায় বলে তো শোনেনি। তেমন হলে চিল, বাজপাখিরা তো বলত।

লোকটা কিন্তু একমনে কাজ করে চলেছে। খুব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ঝুলে ঝুলে এগিয়ে এসেছে সিংহের ঝুলন্ত জালের খাঁচাটার দিকে। আর তারপর কচাকচ করে কেটে যাচ্ছে জালের দড়ি। তার মুখ জালের ভেতরে থাকা সিংহবর্মার কানের খুব কাছে। পশুরাজকে সে যেন কী বলে চলেছে। একহাত দিয়ে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে অন্যহাতে জাল কাটা খুব শক্ত কাজ। পশুরাজ পশু হলেও রাজা কিনা! তাই ভাল বোঝে।

আধঘন্টার অনেক বেশি পরিশ্রম। একটু পরেই ধপাস ধাঁই! জাল ছিঁড়ে পড়ল সে মাটিতে। বেশ একটু লাগল বটে তবে সিংহের শরীর তো একটু শক্তপোক্ত হবেই। অমনি সব পশুর দল ছুটে এল। সকলেরই কৌতূহল, কী করে মুক্ত হল পশুরাজ?

সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে। সেই মানুষটা আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারল না। ধরা পড়ে গেল সকলের চোখে। অমনি চেঁচামেচি হৈ-চৈ। বাঘ তো লাফ মেরে মেরে তার নাগাল পেতে চাইল। হাতি শুঁড় উঁচিয়ে, জিরাফ গলা বাড়িয়ে চেষ্টা করতে লাগল মানুষটার নাগাল পেতে। কিন্তু অত উঁচু ডালে পাওয়া কি অত সহজ?

চিল বলল, "পশুরাজ বলুন ওর মাথাটা ঠুকরে দিয়ে আসব?"

বাজপাখি আর ঈগল তাতে সায় দিল। এই তিন শিকারি পাখির সম্মিলিত আক্রমণে মাথা বাঁচাতে নিচে পড়বেই। তখন হয় মাথা ফেটে মরবে আর নয়তো পশুদের আক্রমণে। যাবে কোথায় বাছাধন? আমাদের রাজাকে বন্দি করার চেষ্টা? আমরা ছেড়ে দেব?

চিল ঈগলের প্ল্যান সফল হল। মাথা বাঁচাতে মাটিতেই লাফাল লোকটা। সব পশুরা তেড়ে এল। পশুরাজ সিংহবর্মা আদেশ দিলেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে লোকটার ওপর। পশুরাজের মুখ থেকে তার আদেশটা একবার খসলেই শুধু হল।

কিন্তু পশুরাজের মুখ থেকে আদেশ এখনও না আসায় তারা সবাই উসখুস করছে। এদিকে লোকটা তাকিয়ে আছে সিংহবর্মার দিকে। তার তো আর পালাবার কোনও উপায় নেই। চারিদিক ঘিরে তাকিয়ে হিংস্র পশুর দল।

পশুরাজও কিন্তু করুণ চোখে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। সবাই তো অবাক। এই কি সেই সিংহবর্মা যার এক হুংকারে সাগরে ঢেউ ওঠে চল্লিশ থেকে চারশো? এই কি সেই সিংহবর্মা যার এক হুংকারে পাহাড়ে কতগুলো পাথর খসে পড়ে তা কেউ কখনও গুনে দেখেনি? পরিবর্তে একটা নরম দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে। প্রবল প্রতাপান্বিত পশুরাজ কি তবে ভয় পেয়ে গেল তাকে দেখে? এত ক্ষমতা লোকটার?

পশুরাজ অতি ধীর পায়ে এগিয়ে এল লোকটির দিকে। লোকটা তো ভয়ে মরে। কিন্তু পশুরাজ এসে মানুষটার পায়ের নিচে বসে পড়ল থাবা গেড়ে। যেন প্রণাম করছে। যেন বশ্যতা স্বীকার করে নিচ্ছে তার।

দাঁড়িয়ে উঠল পশুরাজ। একটু পরেই সিংহবর্মার এক বিরাট হুংকার। হুংকার করে বলল, "সবাই ভাল করে কান খুলে শুনে রাখস। এই মানুষটি আজ থেকে আমার বন্ধু। আমাদের বন্ধু। কারণ এ সমগ্র পশুসমাজের বন্ধু।"

আসলে হয়েছে কি গাছের ডালে জালের মধ্যে ঝুলতে থাকা অবস্থায় লোকটি যা বলেছিল তা এইঃ লোকটা বলছে সে-ও ওই জাহাজে এসেছে। জাহাজের বদ স্বভাবের লোকেরা আস্তে আস্তে এই জঙ্গলের সব পশুদের ফাঁদ পেতে ধরে নিয়ে যাবার অপেক্ষায় আছে। ফাঁদ পেতে রোজ একটা করে পশু বন্দি করে জাহাজে তুলে নিয়ে যাবে।

সিংহবর্মা প্রশ্ন করেছিল, "কেন? আমাদের নিয়ে কী করবে তারা?"

লোকটা বলছে মানুষ পশুগুলোকে চিড়িয়াখানায় বিক্রি করবে। বন্দি করে রাখবে। অন্য মানুষেরা আটকে থাকা পশুদের দেখে খুব মজা পাবে। আর কিছু লোক পশুদের মেরে ফেলবে।

"কেন?"

"মেরে ফেলে তাঁদের নখ, দাঁত, চামড়া, চোখ, লোম, নাড়িভুঁড়ি এইসব বার করে বিক্রি করবে। এসব জিনিস মানুষের কাছে খুব দামি। এসব জিনিস দিয়ে তারা নানা রকম জিনিস তৈরি করে। আবার ওষুধ তৈরিও হয়।"

সব পশুরা শুনছে আর রাগে তাদের সারা গা জ্বলছে। পারলে এক্ষুনি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে মানুষটাকে। কিন্তু এখনও তারা পশুরাজ সিংহবর্মার কাছ থেকে কোনও আদেশ পায় নি। তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে।

বাঘ বলল, "মহারাজ আমাদের আদেশ দিন এক্ষুনি লোকটার নাড়িভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দিই।"

পশুরাজ সিংহবর্মা রাজকীয় ভাবে হুংকার করে বলল, "আমি রাজা। আমি বীর। আমার কর্তব্য যেমন প্রজাদের রক্ষা করা তেমনি রক্ষা করা বন্ধুকেও। এই মানুষটির মতো কিছু মানুষ অবশ্য নিজেদের স্বার্থে আমাদের ক্ষতি করতে চায়। কিন্তু সব মানুষ খারাপ হয় না। এ গোড়া থেকে আমাদের রক্ষা করতে চেয়েছে। অত ঝুঁকি নিয়ে আমাকে জাল কেটে উদ্ধার করেছে। সিংহের
ধর্ম উপকারীকে প্রতিদান দেওয়া। আমিও আমার সেই কর্তব্য করতে চাই। যাও বন্ধু তুমি মুক্ত। আমাদের কেউ তোমার কোনও ক্ষতি করবে না।"

লোকটি বলল, "আমি পশুদের ভালবাসি আর তাই সে পশুদের এমন কষ্ট দিতে চাই না বলেই আমার সঙ্গে জাহাজের লোকগুলোর মতবিরোধ হয়েছে। ঝগড়া করে তারা আমাকে ফেলে পালিয়েছে। আবার একটা এই রকম লোক নিয়ে এসে পশুদের এক এক করে বন্দি করে নিজের দেশে নিয়ে যাবে।"

সব শুনে পশুরাজ বলল, "দাঁড়াও তোমার দেশে ফেরার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি।"


চিল, ঈগল আর বাজপাখির ওপর ভার পড়ল। তারা একটা ঝোলায় পুরে লোকটাকে ঠোঁটে করে আকাশপথে পাহাড় পেরিয়ে পৌঁছে দেবে পাহাড়ের ওপাশে মানুষের দেশে।

মানুষটি তো ভেবেই পাচ্ছিল না কী করে দেশে ফিরবে। কৃতজ্ঞতায় কেঁদে উঠল। 

সিংহবর্মা দুই থাবা জোড় করে কেশর নেড়ে বলল, "তোমার মত উপকারীর কথা কখনও ভুলবে না পশুরাজ সিংহবর্মা। আর ভুলবে না আমার প্রজারাও। যাও বন্ধু নির্ভয়ে আর নিশ্চিন্তে নিজের দেশে ফিরে যাও। আজ থেকে সব পশুরা সাগরের দিকের সীমানা পাহারা দেবে খুব ভাল করে। জাহাজে আসা সেই বিদেশী মানুষের দল কিছুই করতে পারবে না।"

সব পশুর দল চিৎকার করে বলে উঠল, "জয় পশুরাজ সিংহবর্মার জয়। জয় পশুপ্রেমী মানুষের জয়।"

 (সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : সুদীপ্ত দত্ত

No comments:

Post a Comment