ইচ্ছেকথা : মেঘ-বৃষ্টি আর তুতুন : সুকন্যা দত্ত



মেঘ এসেই গেল। বৃষ্টিও আসব আসব করছে। তবুও তুতুনের কিছুতেই খেলা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। আসুক মেঘ, হোক বৃষ্টি। তুতুন আজ খেলবেই। মা কখন থেকেই ডাকছে, 

"ভেতরে চলে আয় তুতুন। বৃষ্টি আসছে।"

কিন্তু কে শোনে কার কথা! এই তো সবে কাঠবিড়ালিগুলো গাছ বেয়ে নামতে শুরু করল। চড়ুইগুলোও সব হাজির। একটা ফিঙে এসে গাছের ডালে বসল। টুনটুনিদুটো তো সেই কখন থেকে ডেকেই যাচ্ছে। তুতুন বসে আছে বাগানে মাটির ওপর পাতা একটা শতরঞ্চির ওপর। একটু একটু ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। তুতুন বুঝতে পারছে আকাশ কালো করে এল। কিন্তু তোমরাই বলো, এত সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে কারোর কি ভেতরে যেতে ইচ্ছে হয়? তাই তুতুন গোঁ ধরে বসে আছে-এখন কিছুতেই উঠবে না সে। মা এল বলে। ঠিক ধরে নিয়ে যাবে ভেতরে। 

এমন সময় হঠাৎ এক ফোঁটা জল পড়ল তুতুনের কপালে। তুতুন আকাশের দিকে তাকাল। এইভাবেই বুঝি আকাশ বোঝে মনের কথা! তুতুনের বন্ধু তো ওরা সবাই। এখন বন্ধুদের এভাবে ছেড়ে তুতুন কি চলে যেতে পারে? কাঠবিড়ালিটা এখন বাদাম খাচ্ছে। তুতুন রোজ ওর জন্য বাদাম রেখে দেয় একটা বাটিতে। আর পাখিদের জন্য রাখা থাকে একটা ভাঁড়ে জল আর একটা থালায় কাউনের চাল। ওরা সবাই এসে তুতুনের পাশে ঘোরাঘুরি করে আর তুতুন হাততালি দেয়। তুতুনকে ওরা যে ভালোবাসে তুতুন সেটা ভালোই জানে। তুতুনও ওদের খুব ভালোবাসে আর ওদের সাথে খেলে।

নয় বছর বয়স হল তুতুনের। আর তার মধ্যেই তুতুন বুঝে গেছে জীবনে আনন্দ পেতে হলে মনকে সহজ-সরল রাখা দরকার। আনন্দ কথাটার মানে তুতুন অন্যরকমভাবে শিখেছে, নিজের আনন্দ সে নিজেই খুঁজে নিয়েছে। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে ভিডিও গেম, স্মার্টফোন, টিভিকে খেলার সঙ্গী হিসেবে না বেছে প্রকৃতির সান্নিধ্যকে সঙ্গী পাওয়া যে কত আনন্দের এটা যে পায়নি সে বুঝবে না। অথচ জানো, তুতুনের কাছে সহজ ছিল কিন্তু ঐ প্রযুক্তি-নির্ভর বিনোদনই। কিন্তু এক নিমেষে তুতুনের মনকে ওলটপালট করে দিল ঐ মেঘ। একদিন সকালে পড়তে বসে পুব আকাশের সূর্যটাকে যখন মেঘ ঢেকে দিল, তখন তুতুন বুঝল মেঘ আর সূর্যও আসলে খেলা করছে। তুতুনের খুব ইচ্ছে হল বাইরে গিয়ে ঐ মেঘটাকে বলে, "এসো, আমার সাথে খেলো", কিন্তু সে পারেনি। পাখিগুলো, কাঠবিড়ালিগুলো যখন উড়ত, দৌড়োদৌড়ি করত, তুতুনেরও ইচ্ছে হত, ওদের সাথে খেলে। কিন্তু পারতো আর কই!

তুতুনের ছোটবেলা থেকেই কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অবশ হয়ে গিয়েছিল। তাই ইচ্ছে থাকলেও আনন্দের কাছে পৌঁছনোর তার উপায় ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই তুতুনের জীবনে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। এক মেঘলা দিনে তুতুন জানলার কাছে বসেছিল আর হাত বাড়িয়ে সদ্য ঝরা বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে হাতের মুঠোয় ধরছিল। কী যে লুকিয়ে ছিল ঐ বৃষ্টির ফোঁটায়! তুতুনের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রাণ এনে দিল ঐ ছোট্ট ফোঁটাগুলো। কে যেন তুতুনের কানে কানে বললো, "তুতুন, তুমি শিগ্‌গিরি বাইরে এসো। খেলবে না আমাদের সাথে?" 


সেইদিনই তুতুনের পা দুটো অল্প নড়ে উঠেছিল। এরপর থেকে রোজ একটু একটু করে তুতুন পা নাড়াতে পারছিল। তুতুনের বাড়ীতে সবাই খুব খুশী। তুতুনের মা এরপর থেকে তুতুনকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে গিয়ে বাগানে শতরঞ্চিতে বসিয়ে দিয়ে আসে। তুতুন খেলে প্রকৃতির সঙ্গে। প্রকৃতি তো কথা বলতে পারে না। কিন্তু তুতুন ওদের কথা শুনতে পায়। তুতুন বুঝতে পারে প্রকৃতি সবার বন্ধু হতে চায়। সে চুপ করে সবার মনের কথা শোনে। তারপর তার বন্ধুত্বের আশ্বাস ঠিকই দিয়ে যায় কোনো সঙ্কেতের মধ্যে দিয়ে। তুতুন সেই সঙ্কেত বুঝেছিল। তাই তো সে আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠছিল তার শরীরের প্রতিবন্ধকতাকে, মনকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছিল এক চিরস্থায়ী আনন্দের মধ্যে দিয়ে। এই আনন্দ তার কাছ থেকে কেউ কোনোদিন কেড়ে নিতে পারবে না।

বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তুতুনের চোখ-মুখ-কপাল ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। তুতুন দু’হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ-বৃষ্টির বন্ধুত্ব তুতুন যে কোনোদিনও ভুলতে পারবে না। 




অলঙ্করণ : শেলী ভট্টাচার্য্য

No comments:

Post a Comment