গল্পের ঝুলি : কুতুয়া : আবেশ কুমার দাস




তুলসীমঞ্চের পাশে মোটরসাইকেলখানাকে রাখতে রাখতেই চোখে পড়েছিল আশিসের। ছোট্ট ছোট্ট চপ্পলগুলো ছাড়া রয়েছে সিঁড়িতে। মাসিমণি এসেছে তাহলে। ঘরে ঢুকলেই এখন চেপে ধরবে বুঁচি-পেঁচি। ওদিকে আবার বরা থেকেই ফিরছে এখন আশিস। তেল ভরতেই হত আজ গাড়িতে।

রাস্তার এপারে বরা পেট্রোল পাম্প। ওপারেই সেই ঝুপড়ি দোকানটা। মিটারের কাঁটা তখন বাড়ছে চড়চড়িয়ে। আর তার উৎসুক চোখজোড়া ঘুরপাক খাচ্ছিল রাস্তার ওপারে। হুশ করে আওয়ালসিদ্ধির দিকে চলে গেল একটা লরি। দোকানঘরের সামনেটা শুনশান। তিনটে একশোর নোট বের করে দিতে দিতে ভাবছিল আশিস— আর আসবে না এই পাম্পে। জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে বড্ড। মাঝেমাঝেই বলে মাম্মাম, সবকিছুরই একটা শূন্যতা আছে...

মাসিমণির মোবাইল থেকে ফোন করেছিল একদিন বুঁচি, "এসেছে গো?"

"না রে, এখনও আসেনি।"

"ইস, কোথায় চলে গেল! রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে হয়তো। কোথায় বসে বসে কাঁদছে। আর কেউ কি ওকে খেতে দিচ্ছে তোমার মতো!"

মাম্মাম কিন্তু বলেছিল, "রাস্তা ওরা হারায় না..."

পাম্প থেকে বেরোতে যাবে, বউদির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। পাম্পের পেছনের চাপকলটা থেকেই দোকানের জল নেয় বউদি। ওই জলেই চা হয়। তাকে দেখে হেসে বলল, "যাও, গিয়ে বসো। যাচ্ছি জল নিয়ে।"

এরপর যেতেই হয়। নইলে তেল ভরে চুপচাপ চলেই আসত আশিস। মনে হয় আজকাল, ইস, যদি একখানা ছবিও তুলে রাখত মোবাইলে!

চায়ের দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসবে। বউদি বলল, "আবার এসো। আগে তো রোজই আসতে। বোনদুটোকেও আর দেখি না।"

"একটু কাজে ফেঁসে গেছি আসলে ক’টাদিন। আসব।"

বউদিও খেয়াল করেছে তবে! খেয়াল করার কথাই অবশ্য। সকাল-বিকেল দু’বেলাও এসেছে এই সেদিনও। আচমকা এভাবে আসা বন্ধ করলে চোখে লাগবেই।

শীতের গোড়ার দিকে আচমকাই শরীরটা ভীষণ খারাপ হয়েছিল মাম্মামের। বিছানা থেকেই উঠতে পারছিল না ক’দিন। বুঁচি-পেঁচিকে নিয়ে এসে কিছুদিন ছিল মাসিমণি। ওদেরও ইস্কুল আছে আবার। পেঁচি টু আর বুঁচিটা পড়ে থ্রিতে। আশিসই বাইকে চাপিয়ে ক’দিন স্কুলে ছেড়ে আসছিল দুটোকে। সেই থেকে গাড়ি চড়ার মজাটা ভালই পেয়ে নিল দুটোয়। বিকেলের দিকে বায়না ধরত প্রায়দিনই— দাদাভাইয়ের বাইকে চেপে ঘুরে আসবে দু’ চক্কর।

সেদিন বিকেলেও অমনই বেরিয়েছিল আশিস। শীতের ছোট বেলা। বিকেল গড়াতে না গড়াতে লেগে যায় অন্ধকার। কল্যাণী রোডটা পার হলেই শহরের চিহ্ন শেষ। তাপমাত্রার আচমকা হেরফেরটা বোঝা যায় স্পষ্ট। পশ্চিম থেকে পুবে নৈহাটি-হাবড়া পাকা সড়কের দু’পাশে মাইলের পর মাইল খালি ধানিজমি, ফাঁকা মাঠ, গাছগাছালি আর পুকুর-ডোবা। মাঝেমধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব রেখে দেবক বা হামিদপুরের মতো এক-আধখানা গঞ্জ বা গঞ্জঘেঁষা গ্রাম্য এলাকা। অন্ধকার নামল কি নামল না— চারপাশ তেপান্তরের মাঠ। বরার পেট্রোল পাম্পে গাড়ির লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রাস্তার ওপারে ঝুপড়ি দোকানটার দিকে চোখ পড়ে গিয়েছিল আশিসের। চা ফুটছিল হয়তো উনুনে। গনগনে না হলেও আঁচের আভাটুকু টের পাওয়া যাচ্ছিল দূর থেকে। হাতের আঙুলগুলো তখন ঠান্ডায় প্রায় অকেজো।

ঝুপড়ি ধাঁচের হলেও বেশ খানিকটা জায়গা দোকানের ভেতর। একটা তক্তপোশে অল্প বিছানা। হয়তো একেবারে ফাঁকা রাখা ঠিক নয় বলে রাতে কেউ শোয় দোকানে। সন্ধ্যার মুখে একধার থেকে বিছানার অনেকটা গোল করে গুটিয়ে টুকিটাকি জিনিসগুলো তুলে রাখা ছিল। বিছানার লাগোয়া দরমার গায়ে একটা জানলা দিয়ে দেখা যায় পিছনের কলাবনখানা। গরমের দিনে দক্ষিণখোলা জানলাটা রাতে খুলে শুলে হয়তো একেবারে মন্দ হয় না। দরমার ঘরের এককোনায় জলের বড় একটা জালা। উত্তরের দরজার লাগোয়া কোমরসমান ইটের গাঁথনির উপর রাখা আছে কেক-বিস্কুটের বয়ামগুলো। পাশেই গাঁথনি করে বানানো উনুনে জ্বলছিল আঁচ। রাতে ঝাঁপ ফেলে দিলেই বেশ ছিমছাম গেরস্থালি টালির চালের দোকানটার ভেতরে।

চায়ের ভাঁড়ে সবে ঠোঁট ছুঁইয়েছে আঙুলগুলোকে আঁচে সেঁকে নিয়ে। তখনই মনে হল ছোট্ট ছোট্ট হাতে কেউ যেন পেছন থেকে ডাকছে পায়ে খোঁচা দিয়ে। পরক্ষণেই চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিল পেঁচি আর বুঁচি।

"ও দাদাভাই, ও দাদাভাই গো!"

"ওটা তোমার পেছনে গো!"

"পালিয়ে এসো। পালিয়ে এসো।"

উনুনের ওপাশ থেকে একটা চ্যালাকাঠ ততক্ষণে তুলে নিয়েছে বউদি, "যা ভাগ। এমন শয়তান হয়েছে লালুটা! সবার কাছে চাইতে শুরু করেছে। ভয় নেই, কিছু করবে না তোমাদের।"

কিন্তু চ্যালাকাঠের ভয়ে নড়ার বান্দাই নয় লালুও। আশিস পেছন ঘুরে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। একবার আশিসের মুখের দিকে তো পরক্ষণেই বিস্কুটের বয়ামগুলোর দিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল লালুর চোখজোড়া। বুঁচি আর পেঁচি তখন গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে আশিসের।

ফেরার পথে দু’জনের মাঝখানে বসে বলছিল পেঁচি, "তোমার তো খুব সাহস দাদাভাই। আবার হাতে করে নিয়ে বিস্কুট খাওয়ালে ওকে।"

"ভয়ের কী আছে? দেখলি না, বিস্কুট খাবে বলে ডাকছিল কেমন!"

"একদম মানুষের মতো। না?"

"মাটিতে বসে সামনের একটা পা দিয়ে ডাকছিল। যেন হাত দিয়ে ডাকছে!"

আশিস বলল, "বউদি কী বলল শুনলি না? আসলে দোকানেই থাকে কুকুরটা। ভয়ের কিছু নেই। যে দোকানে আসে সবাইকেই নাকি ওভাবে ডেকে বিস্কুট চায়।"

"ওকে তো খেতে দেয় দোকান থেকে?"

"তাতে কী হয়েছে? খদ্দেরদের কাছেও যদি পায়। উপরি লাভ।"

মাম্মাম শুনে বলেছিল, "লাল কুকুর? দিস, ওদিকে গেলে মাঝেমধ্যে বিস্কুট দিস। লাল কুকুরকে খেতে দিলে রাহুর দশা কেটে যায়।"

মাসিমণিও বলেছিল, "হ্যাঁ, কে কোন ছলে এসে খেয়ে যায়!"

এমনিতেই কুকুরটাকে ভাল লেগেছিল আশিসের। মুখে সাড়াশব্দ নেই। নতুন কেউ দোকানে গিয়ে দাঁড়ালেই চুপিসাড়ে পেছনে গিয়ে বসবে। আর সামনের একটা পা তুলে খোঁচা দিয়ে ডাকবে। চোখাচোখি হলে নিঃশব্দে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিস্কুটের বয়ামগুলোর দিকে একবার আবার পরক্ষণেই খরিদ্দারের মুখের দিকে একবার তাকাতেই থাকবে। প্রথমে ভয় পেলেও পরে লালুকে দেখে মজা পেত বুঁচি-পেঁচিও। যে ক’দিন তারপর মাসিমণি ছিল তাদের বাড়িতে রোজই একবার করে অন্তত বউদির চায়ের দোকানে নিয়ে যেতেই হত দুটোকে। ইতিমধ্যে আশিসের মোটর সাইকেলের আওয়াজও চেনা হয়ে গিয়েছিল লালুর। এমনিতে হয়তো গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকত দোকানের পাশে এককোণে। কিন্তু চেনা শব্দটা কানে গেলেই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে গা ঝাড়া দিয়ে নিত খানিক। তারপরই জিভ বের করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে এসে দাঁড়াত আশিসের সামনে। প্রত্যেকদিনই তিন-চারটে করে বিস্কুট যেন বরাদ্দই হয়ে গিয়েছিল লালুর।

একদিন দোকান থেকে ফেরার পথে বলল বুঁচি, "আচ্ছা দাদাভাই, আমরা তো এই কুকুরটার একটা নাম দিতে পারি।"

"ওর নাম তো আছেই। লালু।"

"আহা, সে তো আমাদেরও ইস্কুলের নাম শ্রেয়সী আর মানসী। আবার তুমি বলো বুঁচি-পেঁচি।"

গিয়ার বদলাতে বদলাতে হেসে ফেলে আশিস, "আসলে তোর নাক বোঁচা ছিল ছোটবেলায়। তাই বুঁচি বলা হত। এটা কি ভাল একটা নাম হল?"

"হ্যাঁ, খুব ভাল নাম। তুমি বেশ ভাল ভাল নাম দিতে পারো। দাও না দাদাভাই ওরও একটা ভাল দেখে নাম!"

টালিখোলা পেরোতে পেরোতে বলেছিল আশিস, "বেশ, ওকে তাহলে আমরা বলব কুতুয়া।"

"ঠিক ঠিক। কুতুয়া।"

বাড়ি ফিরে মাম্মাম আর মাসিমণির কাছে গল্প করত দু’জনে, "কুতুয়াটা না একদম পোষ মেনে গেছে গো দাদাভাইয়ের। দাদাভাই গেলেই বিস্কুট খাবে বলে কী লাফালাফি করতে থাকে!"

মাম্মাম সেরে উঠলে বাড়ি ফিরে গেল মাসিমণিরা। যাওয়ার দিন বলেছিল পেঁচি, "কুতুয়াটাকে আর দেখতে যাওয়া হবে না আমাদের।"

"কেন হবে না? তোদের আমি রবিবার করে নিয়ে যাব। দেখিয়ে আনব।"

"হ্যাঁ, নিয়ে যেও তো। আর তুমি কিন্তু রোজ ওকে বিস্কুট খাইয়ে আসবে দাদাভাই। আশা করে বসে থাকবে বেচারা।"

রোজ না হলেও সপ্তায় তিন-চারদিন করে যেতই আশিস। রবিবার বা ছুটির দিনে মাসিমণির বাড়ি থেকে নিয়ে যেত বুঁচি-পেঁচিদেরও।

মাসদেড়েক আগে এক রবিবার সকালের কথা। বুঁচি-পেঁচিকে নিয়ে বউদির দোকানে গিয়েছিল আশিস। সচরাচর দোকানের সামনেই কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকত কুতুয়া। সেদিন ছিল না। উনুন থেকে কেটলি নামাতে নামাতে চিন্তিত মুখে বলল বউদি, "লালুকে কাল সকাল থেকে পাচ্ছি না জানো! কোথায় যে গেল! এমন তো করে না কখনও।"

"সে আবার কী! এই ধারেকাছেই তো বসে থাকে দেখি।"

"হ্যাঁ, বড়জোর উঠে পাম্পের দিক থেকে ঘুরে আসত এক চক্কর। কাল সকালেও ছিল এখানেই। সওয়া দশটা নাগাদও দেখেছি। একটু ভিড় ছিল দোকানে তখন। ব্যস্ত ছিলাম। সেই ফাঁকে উঠে যে কোনদিকে গেছে খেয়ালই করিনি।"

"এরকম গেছে নাকি আগে কখনও?"

"না যায়নি তো। তার জন্যই তো চিন্তা করছি আরও। রাস্তাঘাট তো বিশেষ চেনেও না ও। অন্য কুকুরের সঙ্গে দলে পড়ে বেশিদূরে চলে গেলে..."

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না আর সেদিন বউদির দোকানে।

মাম্মাম শুনে বলেছিল, "কুকুর তো কখনও ছেড়ে যায় না মনিবকে। আর সব্বাই বেইমানি করে। করে না একমাত্র কুকুরই।"

কিন্তু দিন গেল, সপ্তা গেল, মাস পেরিয়ে গিয়েও ফিরে এল না কুতুয়া। মাঝে একটা ইন্টারভিউ নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আশিসও। দু’-একদিন তারই ফাঁকে যেতে হয়েছে বরার পেট্রোল পাম্পে। গাড়ির লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খেয়াল করেছে কেমন খাঁ খাঁ করছে বউদির দোকানের সামনেটা। হাতে সময় থাকলেও ঢুকতে ইচ্ছে করত না দোকানে।

ইন্টারভিউয়ের পর্বও মিটল একদিন। গরম কেটে বর্ষা এসে পড়ল ইতিমধ্যে। একদিন পাম্প থেকে বেরোনোর মুখেই ঝেঁপে বৃষ্টির মধ্যে পড়ে গিয়ে বাধ্য হয়েই ঢুকে দাঁড়াতে হয়েছিল দোকানে। নিজে থেকেই বলল সেদিন বউদি, "লালু বোধহয় ফিরবে না গো আর।"

"কেন ফিরবে না? ঠিক গন্ধ চিনে চিনে ফিরে আসে কুকুর।"

বলে ফেলেও মনে হল আশিসের— যেন বউদিকে নয়, নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতেই বলল এই মুহূর্তে কথাটা।

যাতায়াতের পথে সাইকেল থামিয়ে এই দোকানে দু’দণ্ড বসে চা খায় দেবক বা রামচন্দ্রপুরের দিক থেকে আসা অনেক হাটুরে ধরনের লোকই। জরুরি কাজে নৈহাটির দিকে যাওয়ার পথে যেহেতু পড়ে দোকানটা। আর বৃষ্টি-বাদলায় হঠাৎ আটকে পড়তে হলে তো কথাই নেই। টালিখোলা থেকে সেই আওয়ালসিদ্ধি অবধি পাকা সড়কের লাগোয়া ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঝুপড়ি দোকানগুলোই সেই মুহূর্তে পথিক বা সাইকেল-মোটর সাইকেলের আরোহীদের ভরসা। চায়ের সঙ্গে বিস্কুটটা, কেকটা, পাউরুটি-অমলেটটাও বিকোতে থাকে তখন হু হু করে।

বাইরে যখন তেড়ে বৃষ্টি হচ্ছে, দোকানের ভেতর বেঞ্চিতে বসে সেই মুহূর্তে বিড়ি টানছিল এই ধরনেরই একটা গ্রামের লোক। আশিসের কথায় সায় দিল লোকটাও, "ঠিকই। কিছুদূর ছেড়ে ছেড়েই পেচ্ছাপ করতে করতে যায় কুকুর। আবার ফিরে আসে সেই গন্ধ চিনে চিনেই।"

"কী জানি! এতদিন হয়ে গেল। আসার হলে এর মধ্যে কি আর আসত না?" 

চিন্তিত মুখে বলতে থাকে বউদি, গাড়ি-টাড়ি চাপা পড়ল নাকি কোথাও তা-ই বা কে জানে! যা স্পিডে যায় গাড়িগুলো সব। দেখি তো দোকানে বসে!"

ভাঁড়ে চুমুক দিতে গিয়ে আশিসের জিভটা পুড়ল হঠাৎ।

মাসিমণির বাড়িতে গেলেই রোজ ধরত বুঁচি-পেঁচিও। একদিন প্রায় আর্তনাদের সুরেই বলে ফেলল পেঁচি, "কুতুয়াটা কোথায় চলে গেল!"

হঠাৎ মনে হল আশিসের। ইস, যদি একখানা ছবি তুলে রাখত মোবাইলে!

কাল রাতে হঠাৎই ভেঙে গিয়েছিল ঘুমটা। শুয়ে শুয়েই শুনতে পাচ্ছিল একপাল কুকুরের চেঁচামেচি। রাতবিরেতে এমন শোনা যায় সব পাড়াতেই। বিশেষ করে দলছুট হয়ে এক গলির কুকুর যদি ঢুকে পড়ে অন্য গলিতে আর রক্ষে থাকে না। কিন্তু চারদিক থেকে সেই উন্মত্ত চেল্লামেল্লির মধ্যেই যেন আবছা হয়ে কানে আসছিল একটুকরো করুণ কান্নার আওয়াজ। কুকুরের কান্না। আশপাশের একটানা চিৎকারের মধ্যে ওই একটুকরো কান্নাটুকুই যেন ছিল বেমানান। দলছুট।

সকালে মুখ ধোওয়ার সময়ও মনে পড়ে গিয়েছিল রাতের কথাটা।

কিন্তু বাবা ব্যাঙ্কে যাওয়ার কথাটা তোলায় তখন চাপা পড়ে গিয়েছিল চিন্তাটা।

ব্যাঙ্ক থেকে ফিরতে ফিরতে বেজে গেল সাড়ে বারোটা। অল্প একটু বিশ্রাম নিয়ে স্নানে ঢুকবে ভাবছে। বাঁশ-কাগজের খামে তখনই এল সেই চিঠিটা। ব্যস, নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠল তারপর। মাসিমণির বাড়ি, জেঠুমণির বাড়ি ফোন করতে শুরু করল মাম্মাম।


"দাদাভাই, আর গিয়েছিলে গো কুতুয়ার কাছে? ফিরেছে গো ও?"

আজকের দিনেও যে তাকে দেখামাত্রই জড়িয়ে ধরে এই প্রশ্নটাই করবে বুঁচি জানতই আশিস।

চুপ করে থাকে সে।

মাসিমণি বলে, "ছাড়ো এখন দাদাভাইকে। সবে বাড়ি ফিরল। হাতমুখ ধুতে দাও। রাস্তার কুকুর। ওদের কি ঠিক আছে কিছুর? আজ এখানে কাল ওখানে। আবার দেখো কোথায় গিয়ে আস্তানা গেড়েছে।"

মাম্মাম হঠাৎ বলে ওঠে, "লাল কুকুর বলেছিলি না? আর দেখতে পাবি না ওকে।"

অবাক চোখে তাকায় আশিস।

মাম্মাম বলতে থাকে, "মানতে চাস না তো কিছু, তাই তোকে বলিনি এতদিন। তোর ঠিকুজিটা নিয়ে মাঝে একদিন গিয়েছিলাম সুজিতের কাছে। দেখেশুনে বলল, ছক তো খুবই ভাল এ ছেলের। কিন্তু রাহুর একটা খারাপ ফেজ চলছে এখন। তবে কেটে যাবে খুব শিগগিরি। দ্যাখ, তোর মতো ছেলে পাশ করে বসে আছিস বাড়িতে। এত জায়গায় ইন্টারভিউ দিচ্ছিস। ভালই হয় বলিস। অথচ ডাকে না কেউই। তোকে বলেছিলাম না, লাল কুকুরকে খেতে দিলে রাহুর দশা কেটে যায়। তোর হাতে যেটুকু সেবা পাওনা ছিল নিয়ে চলে গেছে।"

মাসিমণি বলে, "হ্যাঁ, হতেও পারে। বলেছিলাম না, কে কোন ছলে এসে খেয়ে যায়!"

কুতুয়াটাকে এই কয়েক মাস বিস্কুট খাওয়ানোর দরুনই আজ দুপুরের ডাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা এল কিনা জানে না আশিস। বিশ্বাস করা মুশকিল এসব কথায়। শুধু মনে পড়তে থাকে সেই কুতকুতে দুটো চোখের চাহনি। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে বসে সামনের একটা পা হাতের মতো করে তুলে মানুষের কায়দায় ডাকা।

সত্যিই আর দেখা হবে না কোনওদিন কুতুয়াটার সঙ্গে?

এত আনন্দের দিনেও খালি এটুকু মনে করেই চোখের কোনা ভিজে ওঠে আশিসের।


অলঙ্করণ : আবির

No comments:

Post a Comment