গল্পের ঝুলি : সিংহের দন্তচিকিৎসা : অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়





গভীর জঙ্গলে সিংহটার সেদিন বড় মন খারাপ। তিনদিন তার পেটে কিছু পড়েনি। পেটের মধ্যে থেকে থেকে গুরুম গারাম ডাক শোনা যাচ্ছে। খালি পেট হলে যা হয় আর কি! আহা, নধর মাখন চিক্কন গায়ের চিতল হরিণগুলো এইসময়ে সামনের ঝিলটাতে জল খেতে এসেছে দল বেঁধে। সিংহের বড় সাধ হল, এক ছুটে চকিতে একটা হরিণের টুঁটি টিপে ধরে। কিন্তু ইচ্ছে হলেই তো আর সব সময়ে উপায় থাকে না! সিংহটার গায়ে একরত্তি জোর নেই, যে সে দৌড়ে গিয়ে একটা হরিণের ঘাড় কামড়ে ধরবে।

এখন জঙ্গলে ঘোর অন্ধকার নেমে আসছে। মুখ তুলে সিংহ দেখে, মাথার উপর গরানগাছগুলোর উঁচু উঁচু শাখায় শেষবেলার আলো পড়েছে। যতটুকু আকাশ দেখা যাচ্ছে, তাতে দৃশ্যমান হচ্ছে পাখিদের দল বেঁধে ঘরে ফেরার দৃশ্য। আহা, যদি একটা পাখিও কোনও কারণে টুপ করে খসে পড়ত, তবে অন্তত আজকের জন্য তার পেট খানিকটা শান্ত হতো। শরীরের ভিতর থেকে একটা অসম্ভব রাগ আসছে। কিন্তু দুর্বল সিংহ তার গলা দিয়ে জলদগম্ভীর আওয়াজ করতে আজ অক্ষম। যদিও সে তেমন কিছু বুড়ো হয়েও যায়নি এখনো।

আসলে হয়েছে কী, হপ্তাখানেক আগে একটা নীলগাইয়ের বাচ্চাকে বাগে পেয়ে, তার ঘাড়ে আচমকা লাফিয়ে পড়ে সিংহ তাকে শিকার বানিয়েছিল। কিন্তু যেই না সে নীলগাইয়ের একটা হাড় বেশ কায়দা করে চিবোতে গেছে, অমনি তার কষের দাঁত একেবারে ঝনঝন করে উঠল। তড়িঘড়ি হাড়টা মুখ থেকে ফেলে দিয়ে বিশাল এক হুংকারে জঙ্গল কাঁপিয়েছিল সে। সেই আওয়াজ শুনে বাঁদরের দল দাঁত খিঁচিয়ে উঠেছিল। জল খেতে আসা হরিণেরা পড়িমরি করে ছুটেছিল ডেরার দিকে। গাছের মাথায় ঘরফিরতি পাখিরা কিচির মিচির শব্দ করে উড়ে গিয়েছিল।

সিংহের কষ দাঁত গিয়েছিল ভেঙে। যন্ত্রণা তারপর থেকে বেড়েই চলেছে, কমার লক্ষণ পর্যন্ত নেই। সে তারপর থেকে শিকার করা জিরাফের মাংস বেশ বুঝেশুনে হাড়টাড় বাদ দিয়ে খেয়ে খিদে মিটিয়েছে। না খেয়ে শরীর দুর্বল হয়ে গিয়ে সিংহ আজ ভয় পেয়েছে। এমনভাবে শিকার না করে না খেয়ে থাকলে নির্ঘাত মৃত্যু, সেটা সে বেশ ভাল করেই জানে।

যখন দাঁতের যন্ত্রণায় সিংহ ধুঁকছে, ঠিক তখুনি সামনের বট গাছের ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে, দোল খেতে খেতে, একটা উটকো বাঁদর দাঁত বার করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে বলে উঠল, “কেমন মজা, কেমন মজা? দাঁতের ব্যাথায় পাচ্ছ সাজা!”

খালি পেটে কারই বা রসিকতা সহ্য হয়? কিন্তু দাঁতের ব্যথায় কাতর সিংহ খুব রেগে গেলেও মুখে কিছু বলতে পারে না। এবার ফক্কড় বাঁদরটা বলে, “কী খুড়ো, তোমার তর্জন গর্জন কোথায় গেল? এখন এই দুর্বল শরীরে লেজ নাড়ানোর ক্ষমতা পর্যন্ত নেই তোমার। সাধে কি বলে, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝাটা খুব প্রয়োজন! কিছু মনে কোরো না খুড়ো, অকারণে প্রাণিহত্যা জঙ্গলের নিয়মবিরুদ্ধ, তুমি জানতে। তা সত্ত্বেও নিরীহ প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলতে। সেই কারণে খুড়িও তোমাকে ছেড়ে গেছে। জঙ্গলের নিয়ম না মেনে বড় পাপ করেছ হে। তাই তোমাকে বনবিবি শাস্তি দিয়েছে।”

বাঁদরের কথা শুনে বড় আফসোস হয় সিংহের। সে মাথা নাড়িয়ে দুর্বল শরীরে হাঁফাতে থাকে আর ভাবে — কী কুক্ষণেই না অকারণে প্রাণী হত্যা করার নেশা ধরিয়েছিল। পেটে খিদে না থাকলেও হরিণ আর জিরাফের দলের পিছনে ছুটে গিয়ে শিকার করেছে। সিংহী কত বার বারণ করেছে। তার একটা কথাও কোনোদিন শোনেনি সে। তাই একদিন ছানাপোনাদের সাথে নিয়ে সিংহী চলে গেল দূরের জঙ্গলে। সেই থেকে সিংহ একেবারে একা।

সিংহকে বেচাল দেখে বাঁদর বলল, “উপায় আছে খুড়ো। দাঁত যদি ভালো করতে চাও, আমার কথা শুনে চলতে হবে।”

সিংহ ক্ষীণ গলায় বলল, “যা বলবে তাই শুনব। আর কোনোদিন জঙ্গলের নিয়ম ভাঙব না। আমায় বলো কী করণীয়।”

“ওই যে দূরে উঁচু পাহাড় দেখতে পাচ্ছ, ওই পাহাড়ের মাথায় আছে একটা গুহা। কষ্ট করে যদি ওই পর্যন্ত পৌছতে পারো, তবে তোমার দাঁত ভালো হয়ে যাবে।”

দাঁত ভালো হয়ে যাওয়ার কথা শুনে বেচারা সিংহ নড়ে বসে। উঠে দাঁড়াবার শক্তি তার নেই। কেশর ভর্তি মাথাটা বোঁ বোঁ করে পাক খায়।

“আচ্ছা, বুঝেছি। না খেয়ে তোমার গায়ে আজ একরত্তি শক্তি নেই। দেখছি কী করা যায়।”

এই না বলে, বাঁদর এক লাফে তিনটে গাছ পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এলো একছড়া কলা নিয়ে। কলার ছড়া সিংহের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “ভাঙা দাঁত নিয়ে এখন তোমায় কলা খেয়েই কাটাতে হবে। মাংস টাংস খাওয়া চলবে না বাপু।”

সিংহ বেজার মুখ করে কলা দিয়েই পেট ভরায়। নইলে উঠে দাঁড়াতেও পারবে না আর গুহায় গিয়ে তার দাঁতের চিকিৎসা করাও হবে না। সিংহে কলা খায়, এমন ঘটনা বাঁদর তার জীবনে কোনোদিন দেখেনি। তাই সে বিশাল এক গাছের গুঁড়ির আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফিকফিকিয়ে হাসতে লাগল।

পাহাড়ের মাথায় গুহা পর্যন্ত পৌঁছতে সিংহের পুরো তিনটে দিন কেটে গেল। দুর্বল শরীরে একটানা পথ চলা তার পক্ষে বেশ কষ্টের ছিল। বাইরে থেকে গুহার মুখটা দেখা যায় না। ঝোপ জঙ্গলে ঢাকা পড়ে আছে। সূর্যের আলো বিশাল পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এখানে খুব একটা সহজে ঢুকতে পারে না। সারা রাস্তা সিংহ বাঁদরের সাথে একটা কথাও বলেনি। সে হচ্ছে জঙ্গলের রাজা। ইতর তুচ্ছ বাঁদরের সাথে কথা বলে নিজের সম্মান নষ্ট করা যায় নাকি? এদিকে কৌতূহল কিছু কম হচ্ছে না। কী এমন আছে এই গুহায়, যা তার দাঁত ভালো করে দিতে পারবে?

গুহামুখের কাছে পৌঁছে বাঁদর সিংহের থেকে কিছুটা তফাতে বসে বলল, “ভালো করে শোন খুড়ো। এখানে তোমার গায়ের জোর দেখাতে যেয়ো না কিন্তু। যদি দাঁত ভালো করতে চাও, যা বলব সব শুনবে। আমি গুহার ভিতর থেকে যতক্ষণ না বাইরে আসছি, তুমি চুপ করে ওই পাথরটার উপরে বসে বিশ্রাম করো। কলা-টলা খেয়ে একটু জোর এসেছে গায়ে। কিন্তু সামনে যদি কোনও শিকার পাও, ভুলেও তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যেয়ো না কিন্তু! আসছি এখুনি।”

বাঁদরটা চলে যেতে গুহার পাশের পাটকিলে রঙের পাথরের উপর লেজ গুটিয়ে বসে থাকল সিংহ। চোখ বুজে একটু ঘুমিয়ে নিল। হঠাৎ মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে, কুচকুচে কালো শরীরের এক বুড়ো মানুষ তার কিছুদূরে দাঁড়িয়ে। হাতে তার ঢাল আর বল্লম। বাঁদর এক লাফে সিংহের মাথার উপরে গাছের ডালে দোল খেতে খেতে বুড়োকে উদ্দেশ্য করে বলল, “দাদু, এই সেই সিঙ্গি! নাও এর দাঁতটা একটু দেখো দেখি। বেচারা না খেতে পেয়ে মরতে বসেছে।"

এদিকে হাতের সামনে আস্ত একটা মানুষ পেয়ে সিংহের তো মুখ দিয়ে লালা ঝরতে শুরু করেছে। কিন্তু বাঁদরের কথা না শুনলে দাঁত ভালো হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই, তাও সে ভালো করেই জানে। মানুষটা স্থির দৃষ্টিতে সিংহের দিকে তাকিয়ে ভেবে নিচ্ছে তার উপর সিংহের ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনও সম্ভাবনা আছে কি না। যদি ঝাঁপায়, তাহলে তার বল্লম সোজা গেঁথে যাবে সিংহের বুকে। মানুষ খাওয়ার লোভ সম্বরণ করতে সিংহ অন্যদিকে মুখ ফেরায়।

বুড়ো মানুষটা এবার কাছে আসে। সে জঙ্গলের ভাষা জানে। কাছে এগিয়ে এসে বলে, “বড় করে হাঁ করো দেখি বাপু। খবরদার একদম চালাকি করবে না। আমার কোনও ক্ষতি হলে বাঁচবে না তুমিও।”

বাধ্য ছেলের মতো সিংহ তার মুখ হাঁ করতে ভালো করে সিংহের মুখের ভিতর নজর চালিয়ে বুড়ো বলে, “হুম, একেবারে ঠিক হয়ে যাবে। শুধু দাঁতের ভিতর একটু ফুটো করতে হবে।”

এই কথা বলে বাঁদরকে আড়ালে ডেকে নিয়ে সেই বুড়ো ফিসফিস করে কিছু নির্দেশ দিতে বাঁদর একছুটে গুহার ভিতর ঢুকে নিয়ে এলো লোহার তৈরি তীক্ষ্ণ ফলা আর একগাছা দড়ি। বুড়োর পায়ের কাছে সেসব নামিয়ে দিয়ে এক লাফে গাছে উঠে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। বুড়ো সেই লোহার ফলা পাথরে ঘসে ঘসে মসৃণ আর ছুঁচলো করে তুলল। বাঁদর কিছু সময় পর ফিরে এল একগুচ্ছ লতাপাতা নিয়ে। তারপর লতাপাতা পাথরের উপর আর একটা পাথরের টুকরো দিয়ে ঘসে ঘসে বুড়ো বানাল পাতার রস।

বাঁদর বলল, “দেখো খুড়ো, ঝপ করে আবার তোমার চোয়ালটা বন্ধ কোরো না বাপু। তাহলে কিন্তু আমাদের সব্বোনাশ।”

সিংহ হাঁ মুখ করেই, ‘ঘু ঘু’ , ‘ঘরর, ঘরর’ শব্দ করে জানালো যে সে সব কথাই মেনে নেবে। দাঁতের ব্যথা বড় বালাই। তারপর বুড়ো এক হাতে লোহার তীক্ষ্ণ ফলা সিংহের হাঁ মুখে ঢুকিয়ে ভাঙা দাঁতের উপর বসিয়ে দিতেই সিংহ “উঁ হুঁ হুঁ ঘ্রিয়াও ঘ্রিয়াও” বলে ভয়ংকর আওয়াজ করে উঠল, কিন্তু ভুলেও মুখ বন্ধ করল না। এবার লোহার ফলায় দড়ি জড়িয়ে, একদিকে বুড়ো আর এক দিকে বাঁদর, দড়ির প্রান্ত ধরে টেনে টেনে লোহার ফলা ঘোরাতে থাকল। আস্তে আস্তে ফুটো হল সিংহের দাঁত। তারপর সেই দাঁতের ফুটোয় পাতার রস ঢেলে দিল বুড়ো। কিছুক্ষণ এমন ভাবে চিকিৎসা চলতে লাগল। ধীরে ধীরে দাঁতের ব্যথা কমে যেতে সিংহের চোখ আরামে বুজে এল।

“কী গো কত্তা ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”

বাঁদরের ডাকে সিংহ চমকে তাকায়। এবার মৌচাক থেকে ভেঙে আনা মোম সিংহের দাঁতের ফুটোয় জোরে জোরে চেপে দেয় বুড়ো। তারপর বলে, “সাতদিন শুধু কলা খেয়ে থাকতে হবে। তারপর শিকার টিকার করতে পার। তবে, একটু বুঝে শুনে। প্রয়োজনের বেশি যদি প্রাণিহত্যা করো, বনবিবি তোমাকে ছাড়বে না। খেতে না পেয়ে মরবে তখন।”

“কোনোদিন আর ওই কাজ করব না, এই প্রতিজ্ঞা করলাম। আমি তোমার কী উপকারে আসতে পারি বলো?” সিংহ আজ বড় খুশি।

সিংহের কথা শুনে বুড়ো বলল, “আমি আমার চিকিৎসার বিনিময়ে কিচ্ছু নিই না। সেবা করাই আমার কাজ। অসুস্থ আর বাচ্চা কোনও প্রাণী কোনোদিন মারবে না, শুধু এই কথাটা মনে রেখো। তোমার জীবন। স্বচ্ছন্দে কাটবে। এখন যাও, আমার রান্না বসানোর সময় হল।”

পাহাড়ি পথে সিংহের শরীর মিলিয়ে যেতেই বাঁদর বুড়োকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই বিদ্যে কোথায় শিখলে দাদু?”

বুড়ো গুহার দিকে পা চালিয়ে চলতে চলতে বলল, “সে অনেক হাজার হাজার বছর আগের কথা। আমাদের পিতৃপুরুষ এই বিদ্যে আবিষ্কার করে। তবে মানুষ ছাড়া কারো উপর এই বিদ্যে আমি কখনো প্রয়োগ করিনি। কিন্তু তুই আমার কথা জানলি কী করে?”

বাঁদর দাঁত খিঁচিয়ে হাসতে হাসতে এক লাফে গাছের ডালে লাফিয়ে উঠে বলল, “বাঁদরদের সবার হাঁড়ির খবর রাখতে হয় দাদু। সব কথা ফাঁস করতে নেই। ওই যে বললে সেবা, সেটা আমরাও মাঝে মধ্যে করে থাকি!”

বুড়ো তার হাতের লোহার ফলকটা তুলে, ছুঁড়ে মারার অভিনয় করে হাসতে হাসতে বলে, “সাধে কি আর তোদের বাঁদর বলে? যত্তসব বাঁদরামো!”

অলঙ্করণ : রঞ্জন দাস

2 comments:

  1. আমি জিরাফের মাংস খাব না কোনদিন

    ReplyDelete