গল্পের ঝুলি : মায়ের গল্প : বনশ্রী মিত্র



                     এক

রোজ দুপুরে ইকির মিকিরকে গল্প না শোনালে ওরা কিছুতেই ঘুমোয় না। ইকির, মিকির আমার দুই মেয়ে।পিঠোপিঠি দুই বোন। ইকির এক বছরের বড় মিকিরের থেকে। এই তো ইকির তিনে পা দিল। মিকির দুইয়ে।রোজ-রোজ এত গল্প পাই কোথায়? ওদের আবার বই খুলে গল্প শোনালে হবে না। তাই আপন মনে ভেবে-ভেবেই গল্প শোনাই ওদের। আজ যেমন রান্না করতে করতে বাইরের বট গাছটার দিকে তাকিয়ে এই গল্পটা মাথায় এল! চটপট রুইমাছের ঝোল কড়া থেকে বাটিতে ঢেলেই গল্পের প্লটটা মোবাইলে লিখে রাখলাম।আসলে অনেক প্লট মাথায় এসেই আবার কেমন হাওয়ায় ভেসে চলে যায়। তাই আজকাল লিখে রাখি আমার ফোনে।

দুপুরবেলা বিছানায় যেই একটু গা এলিয়েছি, অমনি শুরু হল ইকির-মিকিরের ফন্দিফিকির। “গল্প বলো,গল্প বলো।” 
তাহলে ঐ রাক্ষসের গল্পটাই এখন বলি। ঐ যে ঐ বট-রাক্ষস!


নন্দীপুর গ্রামের বাইরের দিকটায় ছিল একটা টিলা।সেখানেই ছিল বটরাক্ষসের বাস। তার ভয়ে কেউ ঐ টিলার ধারেকাছে ঘেঁষত না। প্রায়ই গ্রামের বাছুর, ছাগলছানা খেয়ে নিত সে।

বটরাক্ষসের হাত থেকে মুক্তি পেতে গ্রামের লোকেরা শরণাপন্ন হল গ্রামের ইস্কুলমাস্টার মনোজ দত্তের।

“শরণাপন্ন মানে কী মা?” ইকির অমনি প্রশ্ন করে উঠল।মিকিরও বড়-বড় চোখ করে তাকাল আমার দিকে। হ্যাঁ, তাই তো, এত শক্ত শব্দ ব্যবহার করা আমার মোটেও উচিত হয়নি।

তাই সহজ করে ওদের বোঝালাম - বটরাক্ষসের হাত থেকে বাঁচতে গ্রামের লোকেরা সকলে মিলে গ্রামের ইস্কুলমাস্টারের কাছে বুদ্ধি নিতে গেল। মনোজ দত্ত মানুষটা খুব বুদ্ধিমান।তাই গ্রামের লোক কখনো কোনও সমস্যায় পড়লে বুদ্ধি নিতে মাস্টারমশাইয়ের কাছে যায়।

ছুটির দুপুরে খাওয়া শেষ করে মনোজ দত্ত তখন খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন, দল বেঁধে হাজির হল রমেশ, কানাই, রহিম, জগু এবং আরো কয়েকজন।

বটরাক্ষসের কথা মনোজ দত্ত জানতেন। সবার সাথে কথা বলে তাদের চিন্তার কারণটা বুঝলেন।

আমাকে থামিয়ে মিকির প্রশ্ন করল, "আচ্ছা মা, বটরাক্ষস কি মানুষও খায়?"

ও হ্যাঁ, এই কথাটা তো আগে বলাই হয়নি।আজ থেকে অনেক বছর আগে এক সন্ন্যাসী যখন বনের মধ্যে তপস্যা করছিলেন তখন বটরাক্ষস সেই সন্ন্যাসীকে আক্রমণ করে। তপস্যা ভেঙে যাওয়ায় সেই সন্ন্যাসী বটরাক্ষসকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে সে আর কোনদিনও কোনও মানুষ খেতে পারবে না। আর কোনও মানুষকে কখনো যদি সে আক্রমণ করে তবে সে আর রাক্ষস থাকবে না।

"সে আর রাক্ষস থাকবে না? তাহলে সে কী হবে মা?" ইকির অমনি প্রশ্ন করল।

সে কথা তো সন্ন্যাসী বলে যাননি। শুধু বলেছিলেন,  কোনও মানুষকে আক্রমণ করলে বটরাক্ষস আর রাক্ষস থাকবে না। আর সেই ভয়েই তো বটরাক্ষস তারপর থেকে শুধু বাছুরছানা, ছাগলছানা খেয়ে দিন কাটায়।

মিকির আমার আরো কাছে ঘেঁষে বলল , “তাহলে মাস্টারমশাই কী বুদ্ধি দিলেন?”

মনোজ দত্ত, মানে মাস্টারমশাই বেশ বুদ্ধিমান লোক আর নানান বিষয়ে খোঁজখবরও রাখতেন। বটরাক্ষসকে সন্ন্যাসীর দেওয়া অভিশাপের কথাটা তিনি বেশ ভালোই জানতেন। খানিক ভেবে তিনি গ্রামের লোকেদের বললেন, বটরাক্ষসকে লোভ দেখাতে হবে।মানুষ খাওয়ার লোভ! যদি সেই ফাঁদে সে পা দেয়, তাহলে হয়তো তার অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

মনোজ দত্তের এমন প্রস্তাব শুনে গ্রামের লোক প্রথমে ভয় পেয়ে গেল। তারা মাস্টারমশাইকে বলল, সন্ন্যাসীর অভিশাপের ফল কী হতে পারে তা তো কেউ জানে না।যদি মানুষ আক্রমণ করার পর সে মানুষ মরে যায় আর বটরাক্ষস আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখন তো আরও বিপদ! আর তাছাড়া সবারই প্রাণের মায়া আছে। গ্রামের কে-ই বা এমন কাজ করতে রাজি হবে?

ইকির আমায় জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা মা,তাহলে গ্রামের সবাই কি ভীতু?কারুর সাহস নেই!”

তা নয়,তা নয়। সবাই ভীতু নয়।আমি ইকিরকে বোঝালাম।

মনোজ দত্ত গ্রামের সবাইকে থামিয়ে বললেন, “দেখো, কাউকে তো এগোতেই হবে। আর কেউ না পারো,আমি যাবো বটরাক্ষসের টিলায়”।

মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনে তো সবাই অবাক। 
“তা কী করে হয়? আপনি একা কেন এই বিপদের মধ্যে্ যাবেন? আমরা তা হতে দেব না।"
সবাই হৈ-হৈ করে উঠল।

মাস্টারমশাই গ্রামের সবাইকে আশ্বস্ত করলেন।তিনি সামনে এগিয়ে যাবেন আর গ্রামের কিছু লোক কাছেই লুকিয়ে থাকবে।দরকার মতো তারা মাস্টারমশাইকে সাহায্য করবে।

মিকির অমনি চোখ গোলগোল করে বলে উঠল – “আচ্ছত্ত! কী?"

মিকিরকে বললাম, “আশ্বস্ত” মানে গ্রামের লোকেদের মাস্টারমশাই ভালো করে বোঝালেন।

“গ্রামের লোক রাজি হল মা?” ইকির আমাকে জিজ্ঞাসা করল।

গ্রামের সবাই মিলে পরেরদিন সকালে সভা করল।সেই সভায় ঠিক হল, দশ দিন বটরাক্ষসের টিলার কাছে গরু-ছাগলদের যেতে দেওয়া হবে না। সবাই নিজের পালিত পশুদের চোখে-চোখে রাখবে। দশ দিন পরে পূর্ণিমার রাতে মাস্টারমশাই মনোজ দত্ত যাবেন টিলার সামনে। আর পেছনে গ্রামের কয়েকজন লুকিয়ে থাকবে। তারপর লক্ষ্য রাখতে হবে কী হয়।

মাস্টারমশাইয়ের জন্য চট দিয়ে মোটা পোশাক বানাতে শুরু করল কানাই দরজি। চটের পোশাকের তলায় থাকবে লোহার মোটা পাতের বর্ম। গ্রামের কবিরাজমশাই একরকম ওষুধ তৈরি করলেন। সে ওষুধ সারা গায়ে মেখে নেবেন মাস্টারমশাই। বটরাক্ষস আক্রমণ করলে সহজে মাস্টারমশাইয়ের শরীরে বিষ ছড়াবে না।

ইকির, মিকির আমার আরো কাছে এসে বসল। দুজনের চোখে-মুখে কৌতূহল ফুটে উঠেছে।

এর পর দশদিন গ্রামের কোন জন্তুকে বটরাক্ষসের টিলার কাছে যেতে দেওয়া হল না। বটরাক্ষস খিদেতে অস্থির হয়ে উঠল। কয়েকবার গ্রামের আশে-পাশেও ঘুরে এল সে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা একসাথে দল বেঁধে গ্রাম পাহারা দেয়। রাতে মশাল জ্বালিয়ে রাখে। সন্ন্যাসীর অভিশাপের কথা মনে করে আর বটরাক্ষস তাই গ্রামের ভেতর যায় না।


                  দুই

দশদিন পরে পূর্ণিমার রাত। আজ গ্রামের চেহারা অন্যরকম। সবাই একজোট হয়েছে। সবার মনেই চিন্তা আজ রাতে কী হয়! মনোজ মাস্টারমশাই টিলায় যাওয়ার জন্য তৈরি। কবিরাজের ওষুধ সারা গায়ে মেখে নিলেন। লোহার বর্মের ওপর চটের পোশাক পরে নিলেন। রাত তখন প্রায় আটটা। টিলার ওপর জ্যোৎস্নার আলো। সেদিকে চললেন মনোজ মাস্টার আর বাকি গ্রামের লোকেরা একজন-দুজন করে টিলার কাছেই লুকিয়ে থাকল। বটরাক্ষসের এই ক'দিন কিছুই প্রায় খাওয়া হয়নি। সে টিলার ওপর শুয়ে-শুয়ে রাগে ফুঁসছিল। পায়ের আওয়াজে টিলার ওপর থেকে সে দেখল একজন মানুষ টিলার দিকে ধুঁকতে-ধুঁকতে এগিয়ে আসছে। তার হাঁটা দেখে তাকে অসুস্থ মনে হল।খানিক পরেই লোকটা টিলার সামনে হাত-পা ছুঁড়ে শুয়ে পড়ল।

কী ব্যাপার বোঝার জন্য বটরাক্ষস লোকটার দিকে এগিয়ে যেতেই মানুষের শরীরের গন্ধে তার খিদে যেন আরো জেগে উঠল। কিন্তু সন্ন্যাসীর অভিশাপের কথা ভেবে বটরাক্ষস লোকটার দিকে চার পা এগোয় তো দু পা পিছোয়। খানিক পরে আর থাকতে না পেরে বটরাক্ষস মনোজ মাস্টারকে ধরে কাঁধের ওপর তুলতে যেতেই তার হাত-পা অবশ হয়ে গেল। সে উল্টে পড়ল।

মনোজ মাস্টার উঠে গ্রামের লোকেদের তার কাছে আসার জন্য ইশারা করলেন। একটা কাগজের টুকরো মাস্টারমশাইয়ের পায়ের সামনে কোথা থেকে যেন উড়ে এল।

তাতে লেখা ছিল, “সন্ন্যাসীর কথা না শোনার শাস্তি বটরাক্ষসকে পেতে হবে। আজ সারা রাত বটরাক্ষস এভাবেই শুয়ে থাকবে। কাল ভোরবেলা সূর্যোদয়ের পর বটরাক্ষস উঠতে পারবে। তারপর শুরু হবে কঠিন পরিশ্রম। দিনরাত শুয়ে-বসে জন্তু-জানোয়ার মেরে আর দিন কাটবে না তার। কাল থেকে তাকে গ্রামের সব জমিতে লাঙল দিতে হবে। কুয়ো থেকে জল তুলে গ্রামের রাস্তাঘাট পরিষ্কার করতে হবে। এইভাবে একশো বছর তার জীবন কাটবে। গ্রামের লোকেরা তাকে যা খেতে দেবে, তাকে তাই খেতে হবে। রাত্রিবেলায় গ্রাম পাহারা দিতে হবে। একশো বছর এইভাবে পরিশ্রম করে তাকে বাঁচতে হবে। একশো বছর পর বটরাক্ষসের মৃত্যু হবে। তারপর সে মানুষ হিসেবে জন্ম পাবে!”

ইকির, মিকিরের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
“মানুষ হওয়ার জন্য বটরাক্ষসকে এত্ত কাজ করতে হবে মা!” ইকির আমাকে বলল।

আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ,হবেই তো। অনেক কাজ করতে হবে। তবেই না মানুষ! পরিশ্রম করতে হবে।ভালো-ভালো কাজ করতে হবে। তবেই না মানুষের মতো বাঁচা যাবে।”

ইকির-মিকির আমার কথায় গোল-গোল চোখ করে তাকাল।

“গল্পের নাম কী রাখলে মা?” মিকির আমাকে জিজ্ঞাসা করল।

“মায়ের গল্প।” ইকির-মিকিরকে কাছে টেনে বললাম।

“কাজ করলে মানুষ হবে!” এই নামটা কেমন মা? ইকির আমাকে জিজ্ঞাসা করল।

আমি বললাম,হ্যাঁ! তাও হতে পারে।

(সমাপ্ত)

অলঙ্করণ : রঞ্জন দাস

No comments:

Post a Comment