গল্পের ঝুলি : এলিয়েন বন্ধু : শেলী ভট্টাচার্য




একে তো ঘন জঙ্গল, তার উপরে সন্ধে নেমে আসছে .... অন্ধকারের চাদরটা যেন তাড়াহুড়ো করে ঝুপ করে নেমে আসছে পুটুর চারপাশে। এদিকে বাবা অফিস থেকে এসে যদি জানতে পারে যে দামি হেলিকপ্টারটা পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে বেশ কড়া বকুনি দেবে। মায়ের কানে উঠলে তো পুটুর পিঠে অসময়ে দুর্গাপূজার ঢাকও বেজে যেতে পারে। ভেবেই কান্না পেয়ে গেল পুটুর। এই তো কদিন আগে এখানে আসার পথে বায়না করায় শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট থেকে বাবা এই সুন্দর দেখতে হেলিকাপ্টারটা কিনে দিয়েছিল। বনবন করে সেটা ঘুরছিল সারা ঘর জুড়ে। কেন যে পুটু ওটাকে নিয়ে ছাদে গিয়ে আকাশে ওড়ানোর চেষ্টা করতে গেল, সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। এখন অন্ধকারটা আরও ঘন হলে, কী করে খেলনাটাকে পাবে পুটু? যদিও ল্যান্ড করার পর ওটার বুকে একটা ছোট্ট কিন্তু সূক্ষ্ম লাল আলো দপদপ করে অনেকক্ষণ। সেটাকেই এখন গোরুখোঁজা করছে পুটু। 

বাড়িটার পেছনে যে এতো বড় জঙ্গল আর ঘাসের জড়াজড়ি কাণ্ড, তা বাড়ির জানলা দিয়ে দেখেও আগে বুঝে উঠতে পারেনি সে। বরং কলকাতা থেকে ওর বাবার উত্তরবঙ্গের এই চা-বাগান ঘেঁষা জায়গায় বদলি হয়ে আসায় খুশিই ছিল। সবুজে সবুজে ছয়লাপ করা চারিধারটা দেখে ওর চোখ ও মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। তাই তো ছুটিতে দাদানকে এখানে এনে রাখার ব্যবস্থা করল বাবা। কিন্তু এখানে এসে পুটু ওর নিজের বুদ্ধিভ্রমে নিজের বিপদ যেচে ডেকে নিয়ে এলো। ভাবতে ভাবতে মাথাটা নিচু করে আরও মনোযোগ দিয়ে খেলনাটাকে খুঁজতে লাগল ও।


এমন সময় একটা লাল আলোর রশ্মি যেন দ্রুত ওর ডান চোখের কোণের দিক দিয়ে ডান কান ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। আশায় আর আনন্দে পুটুর দুটো চোখ মুহূর্তে ঝলমল করে উঠল। ও ডানদিকে এগিয়ে ওই লাল আলোর রেখাটাকে আতিপাতি করে খুঁজতে লাগল।

খোঁজার নেশায় খেয়াল হয়নি, ইতিমধ্যে ও বেশ গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে। এমন সময় হঠাৎই একটা বড় গাছের গুঁড়ির ওপাশ থেকে কিছু একটা নড়ল বলে মনে হল পুটুর। চলতে চলতে ভয়ে থমকে দাঁড়াল ও। এত ভারী জঙ্গল, যদি কোনো হিংস্র জানোয়ার থাকে, যদি পুটুকে একা পেয়ে একটা থাবা উঁচিয়ে .... ভয়ে দু'চোখ বন্ধ করে দেয় পুটু। আর ভাবতে পারছে না, কী মারাত্মক বিপদের সামনে এসে পড়েছে সে। এর চেয়ে তো মায়ের হাতে মার খাওয়ার বিপদও কম ছিল। তাও কৌতূহলে ধীরে ধীরে চোখের উপরে রাখা দুটো হাতের আঙুল একটু ফাঁক করল পুটু। আর ছিটকে কয়েক পা পিছনে সরে এলো। এটা কী দেখছে ও? এ আবার কী প্রাণী? দুর্গামায়ের মতো বড় বড় টানা টানা দুটো চোখ তার। নাক বলতে গেলে নেই। ঠোঁটের খাঁজ না থাকলেও মুখে একটা বাকা চাঁদের ফালির মতো রেখা আছে। তবে কি হাসছে ও? প্রাণীটা জঙ্গলের বড় বড় ঘাসের মধ্যের অন্ধকারে ডুবে থাকায় হাত পা ঠিক করে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু একটা বেশ মিষ্টি আলোর রেখা ওর গা থেকেই যে ঠিকরে বেরচ্ছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছে পুটু।


এভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর প্রাণীটাই একটু যেন পুটুর দিকে সামনে এগিয়ে এলো। ভয় আর কৌতূহল তখনও দামামা বাজাচ্ছে পুটুর মনে। কে এই নতুন প্রাণীটা? চিড়িয়াখানায় এতরকম প্রাণী দেখেছে পুটু, এরকম কিছু তো দেখেনি! তাছাড়া এমন আলো জ্বলা প্রাণী কি আদৌ হতে পারে?


"জোনাকিপোকা দেখনি বুঝি?" 

এবার চমকে চিৎপটাং হওয়ার জোগাড় হল পুটুর। এই প্রাণী তো ওর মনের প্রশ্ন পড়ে ফেলছে। সে কী করে সম্ভব? ভেবে ভয়ে ডিসেম্বরের ঠাণ্ডাতেও ঘেমেনেয়ে অস্থির হয়ে উঠল পুটু।

"এটা কি তোমার খেলনা?" 

বলে প্রাণীটা এবার আরও কয়েক পা এগিয়ে এলো পুটুর দিকে। এতক্ষণে পুটুর চোখে মুখে হাসির ঝলক খিলখিল করে উঠল। 

হেলিকপ্টারটাকে সামনে পেয়ে পুটুর আনন্দটা ভয় আর কৌতূহলকে ছাপিয়ে গেছে। ও বেশ কয়েক পা সাগ্রহে এগিয়ে গেল এবার প্রাণীটার দিকে। আর প্রাণীটার হাত থেকে নির্ভয়ে নিয়ে নিলো ওর খেলনা হেলিকপ্টারটা। হেলিকপ্টারটা নিতে গিয়েই প্রাণীটা আর পুটুর মধ্যে দূরত্ব কম হওয়ায় প্রাণীটার আলোতে পুটু স্পষ্ট দেখতে পায় ওকে। কেমন যেন একটা থলথলে বাজারের ব্যাগের মতো সবুজ আবরণে ঢাকা আছে ওর দেহ। আর ছোটো ছোটো দুটো হাত সেই পোষাকের দু'পাশের বড় বড় ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। বেঁটেখাটো বেশ হাড্ডাগাড্ডা চেহারা প্রাণীটার। পুটু ওর আলোর উৎসটা একবার গলা উঁচিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা কর‍তেই প্রাণীটা নিজের ডান হাতটাকে হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে এগিয়ে বলে উঠল "হাই, আমার নাম গ্রিনি। আমি জড়িবুটি গ্রহের প্রাণী।"

কথাগুলো শুনে চমকে উঠল পুটু। জড়িবুটি গ্রহ মানে? সেটা আবার কী গ্রহ? তবে কি ভিনগ্রহের কথা বলছে নাকি? মানে এই প্রাণীটা এলিয়েন?চিন্তাগুলোয় পুটুর সারা শরীরে আহ্লাদী শিহরণ জাগতে লাগল। ও উত্তেজনায় প্রশ্ন করল "তুমি এলিয়েন?"

প্রাণীটা ওর খাম্বার মতো মাথাটা উপরনিচ করে 'হ্যাঁ' জানাল। আর তাতেই খুশিতে লাফিয়ে উঠল পুটু।

অমনি গ্রিনি ওর ডানহাতের আঙুলটাকে মুখের কাছে এনে, ফিসফিসিয়ে বলল "শ-শ-শ! এখন এত লাফালাফি কোরো না। অনেকে জেনে যাবে। আমি এখানে একটা জিনিস নিতে এসেছি। নিয়েই চলে যাব। আমার বডিতে যে সেন্সর আছে, তাতেই তোমার খেলনার লাইটটা ধরা পড়েছিল। তাই চোখে পড়ল এটা। তখন তোমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে লুকিয়ে পড়েছিলাম।
আচ্ছা, তোমার নাম বললে না তো?"

"সে কী! তোমার তো দিব্যদৃষ্টি আছে, তাহলে নাম জিজ্ঞেস করছ কেন?" অবাক প্রশ্ন পুটুর।

"সেটা আবার কী?" ততোধিক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল গ্রিনি।

"আরে তুমি যে আমার মনের প্রশ্ন পড়ে বলে দিলে জোনাকির গায়েতেও আলো জ্বলে।"

"ওহহো, সেটা তো আমি জানি যে, যেকোনো মানুষ আমায় দেখলে আমার চেয়েও আমার শরীরের আলোক উৎস দেখে অবাক হয় প্রথমে। আগে একবার এক বিজ্ঞানী আমায় সিমলার জিখু পাহাড়ে দেখে এমন অবাক হয়েছিলেন! সেবার এক সঞ্জীবনী গাছের খোঁজে গিয়েছিলাম।
কিন্তু তার সাথে তোমার ওই দিব্য না কী বললে যেন ... তার কী সম্পর্ক?" গ্রিনির অবুঝ প্রশ্ন।


এবার নিজের মধ্যে একটু বিজ্ঞভাব এনে পুটু বলল "ওসব তুমি বুঝবে না। এগুলো পৃথিবীর ভাষা। তবে তুমি বাংলা ভাষা জানো দেখে অবাক হচ্ছি।"

"আরে তা জানব না কেন? আমাদের পূর্বপুরুষ যে এই পৃথিবীতেই ছিল একসময়। তারপর বিভিন্ন ভাষাভাষী এক হয়ে ওই গ্রহে গিয়ে উঠেছে। সে অনেক কাহিনি। তবে এটুকু জেনে রাখো, তোমার মতো আমার মা বাবাও বাঙালি।"


মা বাবার কথা বলতেই পুটুর মুখ আমসির মতো চুপসে গেল ভয়ে। সে সেই বিকালে কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, আর এখন সন্ধে পেরিয়ে রাত হতে চলল। ও বাড়িতে ফেরেনি। নির্ঘাৎ সবাই ওকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। মা বেজায় রেগেও গেছে বোধ হয়। কী হবে এখন? ফেরার পথটাও তো মনে নেই ওর। ভেবে চোখের কোনায় জল টলটল করে উঠল পুটুর। ওকে এমন দেখে গ্রিনি জিজ্ঞাসা করল "তুমি কাঁদছো কেন? কী হয়েছে?"

"আমি বাড়ি যাব। রাস্তা জানি না। মাত্র ক'দিন হল এখানে এসেছি আমরা। বাবা এখানের অফিসে দু'মাস হল বদলি হয়ে এসেছে। আমরা এখন শীতের ছুটিতে দাদানকে নিয়ে এসেছি। দাদানের যে বড্ড মন খারাপ। তাই ডাক্তারবাবু প্রকৃতির কোলে গিয়ে থাকতে বলেছিলেন।

আমি যে কিছুই চিনি না এখানকার। এখন ফিরব কী করে?" বলে কেঁদে ফেলল পুটু।


"আরে কেঁদো না। আমার সাথে এসো। আমি পৌঁছে দিচ্ছি। আমি এখানকার পথঘাট জঙ্গল সব চিনি। তোমরা তো চারকুঠির বাড়িটাতে থাকো? এছাড়া আশেপাশে তো আর তেমন বাড়ি ... ।"


কথাটা শেষ না হতেই হুড়মুড় করে বলল পুটু "হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই চারকুঠিবাড়িতেই থাকি আমরা।"

"বেশ, বেশ। এখন আমার পিছন পিছন তাড়াতাড়ি এসো।"


গল্প করতে করতে পায়ে পায়ে কখন যে পথ ফুরিয়ে গেল, টেরই পেল না দুজনে। পুটু সামনে চেয়ে দেখল বাড়ির বারান্দার আলোটা দেখা যাচ্ছে। ঠিক তখনই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল গ্রিনি। আর পুটুকে বলল "এবার বাকি পথটা তুমি একা যাও। আমি আর গেলাম না। আর আপাতত আমার কথা কাউকে বোলো না।"


এলিয়েন ব্যাপারটা যে কতটা ভাগ্য হলে দেখে কেউ, আর সেটাও সবার থেকে লুকিয়ে রাখতে হয়, এটা বোঝার মতো বয়স আট বছরের পুটুর হয়েছে। ও হেসে ঘাড় নাড়িয়ে এগিয়ে যেতেই গ্রিনি বলে উঠল "তোমার নামটা বললে না তো?"

এমন সময় পুটু মাকে দেখল বারান্দা দিয়ে সজোরে ডাক পাড়ছে "পুটু-উ-উ"।

পুটু হেসে বলল "ওই যে মা ডাকছে।"


তারপর পকেট থেকে একটা জুসের ছোটো প্যাক বের করে এগিয়ে দিল ওর নতুন বন্ধুর দিকে। সেটা দেখেই গ্রিনি রীতিমতো চমকে গেল।

অত:পর হাত নাড়িয়ে "বাই পুটু" বলে গ্রিনি বিদায় জানাল বন্ধুকে।


পুটু বাড়িতে এসে শুনল দাদানের হঠাৎ করে মন ও শরীর .... দুইখারাপ হয়েছিল। মা সেই নিয়ে ব্যস্ত থাকায়, ওর খোঁজাখুঁজি বেশিক্ষণ ধরে হয়নি। এই কিছু সময় ধরেই খোঁজ চলছিল ওর। আর পুটুও সুযোগ বুঝে বলে দিল তখন মাকে, হেলিকপ্টারটা বাড়ির পেছনের দিকে চলে গিয়েছিল বলে, ও ওটা নিতেই ওদিকে গিয়েছিল।


মায়ের মাথায় দাদানের চিন্তা থাকায় বকুনি কম খেল পুটু। কিন্তু ওর মনখারাপ হয়ে গেছে দাদানকে দেখে। এখানে এসে মনমরা দাদান হেসে টুকটুক করে হেঁটে বেড়াচ্ছিল, চারপাশের প্রকৃতিকে দু'চোখ ভরে দেখছিল। বাবা বলেছিল, দাদান নাকি উড়িষ্যার পুরোনো বাড়িতে থাকাকালীন সামুদ্রিক পরিবেশ নিয়ে রিসার্চ করত। সামুদ্রিক জীবদের যেন অসুবিধা না হয় তাই সমুদ্রের পাড় বরাবর একটা প্লাস্টিকের কারখানা গড়তে দেয়নি। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষে হয়নি। প্রভাবশালীরা পরে কারখানা গড়েছে সেখানে। আর তার থেকে আসা বর্জ্যের মধ্যের কীসব দূষিত পদার্থ সমুদ্রে মিশে যাওয়ায় কত কচ্ছপ, মাছ, সামুদ্রিক পাখিরা মরে গেছে। এদের পেটে নাকি মাইক্রোপ্লাস্টিকের টুকরোও পাওয়া গিয়েছিল। তারপরেও পুটুর দাদান সমুদ্রপাড়ে প্লাস্টিক বর্জনের জন্য প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু সচেতনতা সেভাবে গড়ে তুলতে পারেনি। তাতেই পুটুর প্রকৃতিপ্রেমী দাদান মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মা পুটুকে বলেছে, আজ নাকি দাদান টিভিতে একটা নিউজ রিপোর্টে প্লাস্টিক দূষণের প্রভাবে কারসিনোজেনের পরিমাণ বেড়ে ক্যান্সার বাড়ছে দেখে আবার মনমরা হয়ে গেছে।


রাতের খাবার সময়েও পুটু খেয়াল করল মা বাবার মুখ ভার। বাবা বলছিল

"আমরা আধুনিক হয়েছি, অথচ এখনও পরিবেশ সচেতনতা বোধ আসেনি। এতদিন এই প্লাস্টিক থেকে কত পরিবেশ দূষণ হয়েছে। তাতেও টনক নড়েনি আমাদের। এখন এর থেকে এমন মারণ রোগের কারণ গজাচ্ছে।"


"সত্যিই কী ভয়াবহ পরিস্থিতি!" মায়ের গলায় বিষণ্ণতা।


পুটু রাতে বালিশে মাথা দিয়ে শুতেই মনে পড়তে লাগল ওর এলিয়েন বন্ধুকে। পুটু কি একবার ওকে দাদানের অসুখের কথা বলবে? ও যদি তেমন কোনো ওষুধ জেনে থাকে। ওকে আজ ফেরার সময় পকেট থেকে জুসের প্যাকেটটা দিচ্ছিল যখন, প্যাকেটটার গায়ের স্ট্রটা দেখে ও চমকে উঠে বলছিল 'ড্রপ দা স্ট্র'। আরও বলছিল এসব হাবিজাবি প্রসেসড ফুড খায় না ওরা। কেন এমন বলেছিল, জানা হয়নি তো!


পরেরদিন ভোরে কী একটা আওয়াজে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল পুটুর। শব্দটার খোঁজ করতে জানলা দিয়ে বাইরে চোখ যেতেই দেখল, গ্রিনি দূরে একটা গাছকে শিকড়সমেত ওঠাতে চাইছে। গাছটা একটা বড় গাছে পরজীবীর মতো আটকে আছে। ভোরের নরম আলোতে স্পষ্ট না হলেও পুটু বেশ দেখতে পেল গ্রিনিকে। আর ভাবল, এই সুযোগ। গ্রিনিকে গিয়ে দাদানের অসুখটার কথা বলবে। যেমন ভাবা তেমনই কাজ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুটু পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দ্রুত পায়ে পৌঁছে গেল গ্রিনির কাছে। গ্রিনি ওকে দেখেই হেসে 'গুড মর্ণিং ' বলল। আর জানাল যে, ওকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। কাল সারারাত ও অনেক ভেষজ উদ্ভিদ জোগাড় করেছে। কয়েকটা মাত্র বাকি ছিল। তা করেই ফিরে যাবে নিজের গ্রহে।

তখন পুটু ওকে জিজ্ঞেস করল গতকালের স্ট্রয়ের ব্যাপারটা। তার উত্তরে গ্রিনি ওদের গ্রহের কথা গল্প করে বলল, এই পৃথিবীতে মানুষ আধুনিক হতে গিয়ে যেভাবে উদ্ভিদ ধ্বংস করছে, পরিবেশ দূষণ করছে, তার বিরুদ্ধে যেতেই ওদের পূর্বপুরুষরা রিসার্চ করছিল। আর এভাবেই নাকি একদিন ওদের দুই প্রজন্ম আগের ব্যক্তিরা এই জড়িবুটি গ্রহকে আবিষ্কার করেছিল। ছোট্ট সে গ্রহে প্রকৃতিই প্রাণীর আশ্রয়দাতা, খাদ্যদাতা, বস্ত্রদাতা, এমনকি অসুখের ওষুধের জোগানদারও। প্রধানত প্রকৃতিকে নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসক সেখানে রিসার্চ করে আর ভেষজ ওষুধ বানায়। তার জন্য এই পৃথিবীর কিছু স্থানে এসে ওরা সেসব উদ্ভিদ সংগ্রহ করে। তারপর গরীবদের কাছে অলৌকিক উপায়ে সেসব ওষুধ পৌঁছে দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে আসে গ্রিনি। তাই মানুষ বা প্রাণীর ক্ষতি হতে পারে, এমন যেকোনো জিনিস দেখলেই ও সেটা বর্জন করতে বলে।

পুটু তখন গ্রিনিকে ওর দাদানের কথা বলাতে, ও বলে "তোমার দাদান খুব ভালো মানুষ। তাই এমন গভীর সচেতনতাবোধ তার।" বলে ওর সবুজ পোষাকের পকেট থেকে একটা গাছ বের করে পুটুর হাতে দিয়ে বলে, 

"এই গাছ নিয়ে তোমার দাদানের কাছে দিয়ে বলো তোমায় পাহাড়ের এক ভিনদেশী বন্ধু এটা দিয়েছে। সেই বন্ধুর বাবা জড়িবুটির রাজা। এই গাছের শেকড় বেটে ওষুধ করে ওই প্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত মানুষ সেবন করলে, সেরে যাবে। দেখো, তাতে তোমার দাদুর প্রতি সবার বিশ্বাস বাড়বে। তার এমন মূল্যবান সচেতনতামূলক লড়াইয়ে অনেকে সঙ্গী হবে। আমার বাবা বলেন, আমরা দূষণমুক্ত গ্রহে থাকলেও, যেভাবেই হোক দূষণের বিরুদ্ধে লড়ে যাব আমরা। তাই আজ তোমায় এটা দিয়ে গেলাম। এই গাছ আরও লাগলে ওই নীল পাহাড়ের পেছনের বেগুনি রঙের ফুল ফোটা ক্যাকটাসের বাগানে চলে যেও। পেয়ে যাবে।"


বলেই নিজের পিঠের ব্যাগটা চটপট ঠিক করে নিল গ্রিনি। ওর ঘাড় বরাবর পিঠের লাল আলোটা তখন সবুজাভ হয়ে উঠেছে। গ্রিনি বিড়বিড় করে বলতে থাকল, 

"আমার স্পেসশিপ এসে গেছে। সিগনালিং তাই বলছে।" 
বলে এগিয়ে যেতেই একবার পেছনে ফিরে দেখল পুটু মনমরা হয়ে গাছগুলো হাতে নিয়ে বন্ধুর বিদায়ী পথের দিকে চেয়ে রয়েছে। গ্রিনি তখন পুটুর দিকে এগিয়ে এসে ওর হাতে একটা গ্রিন ছোটো গোলক দিয়ে বলল "এটা আমাদের জড়িবুটি গ্রহের মডেল। সাথে রাখো। কালকের মতোই আবার কোথাও কখনো আমরা অজান্তে কাছাকাছি এলে, এর সিগনালিং চিনে আমি তোমার সাথে দেখা করে নেব। তবে দেখা হোক বা না হোক এই বন্ধুর কথা মনে রেখো, তোমার দাদানের মতো তুমিও মন থেকে পরিবেশ রক্ষা করার শপথ নিও।"

বলে গ্রিনি চলে যেতেই পুটু হাতের গোলকটাকে সযত্নে মুষ্ঠিবদ্ধ করে ধরল।


কিছুক্ষণের মধ্যে পুটু দেখল অদূরের আকাশে ঠিক গোলকটার মতোই একটা ছোট্ট স্পেসশিপ উড়ে যাচ্ছে। পুটু মনে মনে ওর এলিয়েন বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলো ঘরে।

(সমাপ্ত)



অলঙ্করণ : শেলী ভট্টাচার্য্য

1 comment: