বই কথা কও : দ্য লোর‍্যাক্স (The Lorax)- লেখক: ডঃ স্যুস : আলোচনা : সুস্মিতা কুণ্ডু



বইয়ের নাম: দ্য লোর‍্যাক্স (The Lorax)

লেখক: ডঃ স্যুস (Dr. Seuss, Pen name of renowned children’s book writer and illustrator Theodor Seuss Geisel)

প্রকাশক: র‍্যান্ডম হাউস।

প্রকাশকাল : ১৯৭১.

******************

বন্ধুরা, এই বইটি নিয়ে আলোচনা করার আগে অল্প দু’টো কথা লেখকের লেখাগুলি সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে বলে নিই, কেমন? ডঃ স্যুস-এর লেখা আর আঁকা বইগুলো এবং তাঁর সৃষ্টি করা চরিত্রগুলো ইংরাজি শিশুসাহিত্যের এক অন্য দিক খুলে দিয়েছে ছোটোদের জন্য। কখনও বিষয়ের অভিনবত্ব, কখন চরিত্রদের ভীষণরকম মজাদার এবং ইউনিক নামকরণ, কখনও বা ছন্দের খেলায় জিতে নিয়েছে ছোটোদের মন। শুধু নতুন নতুন নামকরণই নয়, সেই সাথে ছবিতে সেই চরিত্রগুলোকেও উপস্থিত করেছেন তিনি। এককথায় বলতে গেলে শিশুদের কল্পনার ডানাকে আরও পোক্ত করতে তাঁর লেখা ও আঁকা বইয়ের জুড়ি মেলা ভার।

দ্য ক্যাট ইন দ্য হ্যাট, হর্টন, দ্য গ্রিঞ্চ, স্যাম-আই-অ্যাম, ইত্যাদি প্রায় শতাধিক জনপ্রিয় চরিত্র সৃষ্টি করেছেন তিনি।

বন্ধুরা, আজ ‘দ্য লোর‍্যাক্স’ বইটার গল্প শোনাবো তোমাদের কারণ এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বইটা শুধু ছোটোদেরই নয়, বড়দেরও পড়া উচিত। অ্যামাজনের জঙ্গল আগুনের কবলে, হিমবাহ গলে চলেছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর চোখ রাঙানি, দূষণে বিপর্যস্ত মানুষ থেকে শুরু করে পশুপাখি সামুদ্রিক জীব সকলে। গাছের পর গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, আকাশ নীল রঙ হারিয়ে ধূসর বর্ণ ধারণ করছে। এই সাংঘাতিক কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে আরেকবার দেখে নেওয়া যাক এই গল্পটা, যেখানে বনভূমির এই অবাধ আগ্রাসনের নির্মম পরিণতিটাকে ডঃ স্যুসের নিজস্ব ঘরানায় পরিবেশিত হয়েছে।

গল্পের শুরুতেই আমরা দেখি যে একটা ছোট্ট ছেলে ‘দ্য স্ট্রিট অফ দ্য লিফ্টেড লোর‍্যাক্স’ ধরে হেঁটে এসে পৌঁছয় শহরের একপ্রান্তে একটা দূষিত এলাকায়, যেখানে পাখি গান গায় না, বাতাসময় দুর্গন্ধ। সেখানে বাস করে 'ওয়ান্সলার(Once-ler)', একটা অন্ধকার ঠাণ্ডা উঁচু ভাঙাচোরা বাড়িতে। একমাত্র ওয়ান্সলারই জানে এই জায়গার এরকম দুর্দশার কারণ। কিন্তু সে সহজে কাউকে দেখা দেয় না, কারোর সাথে কথা বলে না। ছেলেটি পনেরো সেন্ট, একটা নখ, আর তার প্রপ্রপ্রপিতামহর দেওয়া একটা শামুকের খোলসের বিনিময়ে ওয়ান্সলারের কাছে শোনে সেই দুঃখের কাহিনী।

একটা লম্বা পাইপের আগায় চোঙা লাগানো 'হুইস্পার-মা-ফোন(Whisper-ma-phone)' নিচে ঝুলিয়ে দেয় ওয়ান্সলার। তাইতে কান পেতে ছেলেটি শোনে সেই কাহিনী।

অনেক অনেকদিন আগে ট্রাফ্যুলা (Truffula) গাছে ভরা সুন্দর একটা জঙ্গলে এসে উপস্থিত হয়েছিল ওয়ান্সলার। তখন চারিদিকে ছিল অনেক সবুজ ঘাস, পুকুরভর্তি জল, পরিষ্কার মেঘ, সুগন্ধী বাতাস। ট্রাফ্যুলা গাছের তলায় বাস করত বাদামীরঙা 'বার-বা-লুট'রা (Bar-ba-loot)। তারা ট্রাফ্যুলা গাছের ফল খেয়ে পেট ভরাতো। পুকুরে গুনগুন করে গান ধরত গাইয়ে মাছেরা(Humming-Fish)। আকাশে উড়ত সোয়ামি-সোয়ানের (Swomee-Swan) দল।

অনেকদিন ধরে এরকম গাছই খুঁজছিল ওয়ান্সলার সুতো বানানোর জন্য। অমনি একটা সুন্দর ট্রাফ্যুলা গাছ সঙ্গে সঙ্গে কেটে ফেলল সে। তাই থেকে রেশমের মত এক ধরনের মোলায়েম সুতো তৈরি করল ওয়ান্সলার, যার নাম দিল থ্নিড(Thneed)। সেই থ্নিড তৈরি করা মাত্র কাটা ট্রাফ্যুলা গাছের গোড়া থেকে বেরিয়ে এল অদ্ভুতদর্শন একটা প্রাণী। সে কড়া গলায় ওয়ান্সলারকে বলল,

“I am the Lorax, I speak for the trees’

I speak for the trees, for the trees have no tongues.”

লোর‍্যাক্সকে রেগে যেতে দেখে তাকে আস্বস্ত করল ওয়ান্সলার যে চিন্তার কিছু নেই। এই থ্নিড মানুষের ভীষণ উপকারে আসবে কারণ তাই দিয়ে জামা, মোজা, টুপি, দস্তানা, বালিশ, পর্দা, কার্পেট সঅঅঅব কিছু বানানো যাবে।

লোর‍্যাক্স সহমত হয় না ওয়ান্সলারের সাথে। তাকে ফের সাবধান করে যে কেউ এই থ্নিড কিনবেনা আর ওয়ান্সলার খামোকা লোভের ফাঁদে পা দিয়ে ট্রাফ্যুলা গাছ কাটছে। ঠিক এমন সময়ই একজন এসে ৩.৯৮ ডলার দিয়ে কিনে নিল ওই থ্নিডটা। আর যায় কোথায়! রমরমিয়ে শুরু হল ব্যবসা। ওয়ান্সলারের ছোট্ট দোকান ধীরে ধীরে বৃহৎ আকার নিতে থাকল। একের পর এক যন্ত্রপাতি এল, গাড়িঘোড়া এল, এল ওয়ান্সলারের পরিবার আত্মীয়স্বজন। সবাই হাত লাগালো থ্নিড বানাতে, ব্যবসা বাড়াতে, আরও আরও পয়সা কামাতে। সুপার-অ্যাক্স-হ্যাকার(Super-Axe-Hacker) যন্ত্রের এক একটা কোপে কাটা পড়তে লাগল অজস্র ট্রাফ্যুলা গাছ।

ফের দেখা দিল লোর‍্যাক্স। ওয়ান্সলারকে জানালো এত এত ট্রাফ্যুলা গাছ কাটার ফলে ট্রাফ্যুলা ফলের অভাব দেখা দিয়েছে। বেচারা বার-বা-লুটরা না খেতে পেয়ে জঙ্গল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ওয়ান্সলারের একটু খারাপ লাগল, কিন্তু তার লোভে তবুও ভাঁটা পড়ল না। থ্নিড কারখানা আয়তনে আরও বড় হতে থাকল।

ফের এল লোর‍্যাক্স। ভীষণ রেগে জানালো যে কারখানা থেকে বেরনো ধোঁয়াশাতে ছেয়ে গেছে সমস্ত আকাশ। বেচারা সোয়ামি-সোয়ান পাখিরা ভালো করে শ্বাস নিতে পারছেনা, গান গাইতে পারছেনা। তারাও চলে যাচ্ছে জঙ্গল ছেড়ে। শুধু তাই নয়, কারখানার যন্ত্রপাতি থেকে রোজ যে নোংরা আবর্জনা বেরোচ্ছে সেগুলো গিয়ে মিশছে পুকুরের জলে। হামিং-ফিশদের কানকো সেই নোংরায় বুজে গিয়ে খাবি খাওয়ার দশা। তারা কোনওমতে পাখনায় ভর দিয়ে হেঁটে পালাচ্ছে এই দূষিত জায়গা ছেড়ে।

ওয়ান্সলার এবার ভীষণ ভীষণ রেগে গেল লোর‍্যাক্সের কথায়। কারণ সে তো তখন লোভে অন্ধ, ব্যবসা আরও বাড়াতে, আরও পয়সা কামাতে পাগল। থ্নিডের ব্যবসা বাড়াতেই থাকল ওয়ান্সলার, “and biggering... and biggering...and biggering...”

আরও ট্রাফ্যুলা গাছ কাটা পড়তে লাগল।

শেষমেষ সেই দিনটা এল, যেদিন শেষ ট্রাফ্যুলা গাছটাও কাটা পড়ল। গাছ নেই তাই আর থ্নিডও নেই, ব্যবসাও নেই। সব আত্মীয়স্বজন, গাড়িঘোড়া নিয়ে বিদায় নিল। ওয়ান্সলার একা পড়ে রইল সেই ফাঁকা দুর্গন্ধময় কারখানাতে আর রইল লোর‍্যাক্স। করুণ চোখে ওয়ান্সলারের দিকে তাকিয়ে, কিচ্ছুটি না বলে সেই ধোঁয়াশা ঘেরা আকাশের মাঝের একটুকরো ফাঁক দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল লোর‍্যাক্স। আর ফিরে এলো না কোনওদিনও। শুধু লোর‍্যাক্সের ফেলে যাওয়া ক’টা পাথরের ওপর খোদাই হয়ে পড়ে রইল একটা শব্দ ‘UNLESS’

ওয়ান্সলার তখনও বুঝতে পারল না সেই শব্দের অর্থ কী! বছরের পর বছর পেরিয়ে সব আজকের এই ভগ্নস্তূপে পরিণত হল।

ছোট্ট শ্রোতা ছেলেটিকে পরিশেষে ওয়ান্সলার বলল, এতদিন লোর‍্যাক্সের শেষ শব্দটার মানে না বুঝলেও এবারে বুঝেছে। ছেলেটির উদ্দেশ্যে ওয়ান্সলার বলে উঠল, "Unless someone like you cares a whole awful lot, nothing is going to get better. It's not."

ওয়ান্সলার নিজের কাছে এতদিন জমিয়ে রাখা শেষ ট্রাফ্যুলা গাছের বীজটা ছেলেটার হাতে দিয়ে অনুরোধ করল সে যেন আগের মত ট্রাফ্যুলার জঙ্গল তৈরি করে এখানে, এবং কলকারখানার কুঠারের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে গাছকে। তাহলেই আকাশ পরিষ্কার হবে, বাতাস দূষণমুক্ত হবে, জল স্বচ্ছ হবে। তারপর কোনওদিন হয়ত লোর‍্যাক্স আর তার বন্ধুরা আবার ফিরে আসবে এই জঙ্গলে।

গল্পের শেষ এখানেই।

শিশুদেরকে গাছ এবং সমগ্র প্রকৃতির সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সহজ গল্পের ছলে বোঝানোর জন্য বইটি ছোটোদের কাছে তো বটেই এমনকি সমগ্র পাঠকমহলে ভীষণভাবে সমাদৃত হয়। ২০০৭ সালে একটি অনলাইন পোলের মাধ্যমে ‘ন্যাশনাল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন’ ‘দ্য লোর‍্যাক্স’ বইটিকে "Teachers' Top 100 Books for Children" আখ্যা দেয়। ২০১২ সালে ‘স্কুল লাইব্রেরি জার্নাল’-এর একটি সার্ভেতে বইটি ৩৩ নম্বর স্থান পায় "Top 100 Picture Books" এর তালিকাতে।

শুধু তাই নয় ১৯৭২ এবং ১৯৯৪ সালে টিভির পর্দাতে অ্যাডাপ্ট করা হয় বইটি। ২০১২ সালে একটা জনপ্রিয় সিনেমাও তৈরি করে ‘ইল্যুমিনেশন এন্টারটেইনমেন্ট’(ডেসপিকেবল মি/মিনিয়ন সিরিজের সিনেমাখ্যাত)। তাইতে কণ্ঠ দেন নামী অভিনেতা অভিনেত্রীরা। সিনেমাটি রিলিজ করে ‘ইউনিভার্সাল পিকচার্স’। এছাড়াও অডিও বুক এবং ব্রডওয়ে মিউজিকালরূপেও দেখা মিলেছে দ্য লোর‍্যাক্সের।

একটা মজার ঘটনা বলি, যখন প্রথম পাবলিশ হয় তখন দ্য লোর‍্যাক্স বইটিতে ক'টা লাইন ছিল,

"They'll walk on their fins and get woefully weary,

in search of some water that isn't so smeary.

I hear things are just as bad up in Lake Erie."

এই লেখার কারণ ছিল সত্যিই সেই সময় লেক ইরি ভীষণভাবে দূষিত ছিল, মাছেরা দলে দলে মারা পড়ছিল। আশির দশকে নানারকম দূষণবিরোধী পদক্ষেপের পর লেকটির পরিস্থিতির সমূহ উন্নতি হয়। ওহায়ো সি গ্রান্টের দুজন গবেষক ডঃ স্যুসকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন বই থেকে ওই তৃতীয় লাইনটি সরিয়ে দিতে। পাবলিশ হওয়ার প্রায় ১৪বছর পর ওই “I hear things are just as bad up in Lake Erie.” লাইনটি সরানো হয় বই থেকে।

১৯৭১ সালে প্রকাশিত এই বই নিয়ে কম আলোচনা তোলপাড় হয়নি। বেশিরভাগ বইপ্রেমীই বইটিকে সাদরে গ্রহণ করলেও কিছু কিছু সমালোচকের মনে হয়েছে কলকারখানাগুলোকে একটু বেশিই খারাপ ভাবে দেখানো হয়েছে গল্পে। বিশেষত আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ছোটো স্কুল ডিস্ট্রিক্টে ১৯৮৮ সালে বইটি ব্যানও করা হয়। কারণ ওই অঞ্চলের মানুষের মূল জীবিকাই নির্বাহিত হত লগিং ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে। তদের দাবী ছিল কাঠ কাটার এই কারখানাগুলো যত না গাছ কাটে তার থেকে অনেক বেশি গাছ লাগায়। শিশুমনে এই বইটি তাই বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে শিল্প সম্পর্কে। এমনকি টেরি বার্কেট নামে এক লেখিকা এই শিল্পের অন্য দিকটি তুলে ধরার জন্য ‘দ্য ট্রুয়াক্স’ নামের একটি বইও লেখেন, দ্য লোরাক্স এর প্রতিবাদে।

শেষ করি আর একটা ঘটনা বলে। যদিও লোর‍্যাক্স এবং গল্পটার অন্য সব চরিত্র কাল্পনিক তবু মনে করা হয় যে, বিশেষ একটি গাছকে দেখেই নাকি ডঃ স্যুস এই গল্পটা লিখেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডঃ স্যুস ক্যালিফোর্নিয়ার লা হোয়া (La Jolla, California)-তে বাস করাকালীন একটা মন্টরে সাইপ্রেস (Monterey Cypress) গাছ দেখতে পেতেন অবজার্ভেশন টাওয়ার থেকে। সেই একাকী দাঁড়িয়ে থাকা গাছটিকে দেখেই দেখে ট্রাফ্যুলা গাছের কথা লিখেছিলেন বলে স্থানীয় এলাকায় প্রচলিত। গাছটি পর্যটকদের কাছে লোরাক্স ট্রি নামেই বেশি পরিচিত। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই বছর জুন মাসেই(June 16, 2019) সেই গাছটি উপড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে যদিও এই গল্পের মধ্যে দিয়ে গাছটা চিরতরেই থেকে যাবে।



ছবি ও তথ্যসূত্র:


•প্রথম ছবি: পিওয়াকি, উইসকনসিক লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত ‘দ্য লোর‍্যাক্স’ বইটি।

•দ্বিতীয় ছবি: আন্তর্জাল

• https://en.m.wikipedia.org/wiki/The_Lorax

•https://www.smithsonianmag.com/travel/visit-seussical-san-diego-180959997/

•https://www.google.com/amp/s/qz.com/quartzy/1353379/the-us-logging-industry-once-released-a-parody-response-to-the-lorax-called-truax/amp/


2 comments:

  1. চমৎকার আলোচনা। পাঠকের বইটা পড়ার আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। বইটা কিনতেই হবে দেখছি।

    ReplyDelete
  2. আমার খুবই পছন্দের গল্প। সত্যিই এই বইটি সবার পড়া দরকার। লেখা ভালো লাগল।

    ReplyDelete