গল্পের ঝুলি : স্কুল থেকে ফেরবার পথে : প্রদীপ কুমার বিশ্বাস



স্কুল বাসটা লজঝড়ে । প্রায়ই ঠিক বাড়ি ফেরবার সময়ই তার কিছু না কিছু বিগড়ায়। ড্রাইভার, মেকানিক তার মেরামতিতে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে শ্যাম, নিত্য, দেবা আর কার্ত্তিক এই চার বন্ধু চুপিসাড়ে বাস থেকে নেমে পড়ে। শর্টকাটের রাস্তায় তারা অনেক আগেই বাড়ির কাছে পৌঁছে যায়।

গরমের ছুটির পর আজ প্রথমদিন স্কুল খুললো আর তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল। কিন্তু সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফেরবার পথে ঠিক শঙ্খনালার সাঁকোর কাছে বাসটা বেশ বাজেভাবে বিগড়ে গেল। শঙ্খনালার পাড় ধরে একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যায় তাদের পছন্দের বাগান-বাড়িটা। সেখানে নানারকম ফলের গাছের ছড়াছড়ি। অন্য বাগান-বাড়িগুলোর মতো এর পাঁচিল তালগাছের মতো লম্বা নয়। গেটটাও তার সাথে মানানসই সাইজের। বেশ বেঁটে-খাটো । বাগানের মালী এবং পাহারাদার লখন দিনদুপুরেই সিদ্ধি খেয়ে চোখ লাল করে থাকে। লখনের এই গুণের জন্যই এই বাগান বাড়িটা ওদের আরও পছন্দ।

গরমের ছুটির পর এই পথে আজ এই প্রথম আসা। বাগান-বাড়ির গেটের সামনে এসে ওরা সবাই থমকে দাঁড়ালো। এই ক'টা দিনে এই বাগানবাড়ির দেওয়ালে নতুন ইটের সারি চাপিয়ে সেটা বেশ অনেকটাই উঁচু করা হয়েছে। নতুন দেওয়ালের সঙ্গে মানানসই উঁচু নতুন গেট। সেটা আবার ভেতর থেকে বড় তালা দিয়ে বন্ধ করা। গেটের রেলিঙের ফাঁক দিয়ে যতোটুকু দেখা যায়, তাতে ওরা হতাশ হয়ে দেখল যে প্রায় সব গাছই ফাঁকা। কার্তিক ফিসফিসিয়ে বলে,“ভাং-খেকো ফোকলা মালী পেয়ারা, আম, সবেদা সব বাজারে বেচে দিয়েছে”। 

নেত্য ভেংচে ওঠে,“একটা পাকা সবেদাও তো কামড়াবার উপায় নেই ওর”।

কার্তিক আর দেবার নজরে এলো, দূরে এক গাছের তলায় ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখা একটা মই। নিত্য দেখে যে গেটের সামনের দেওয়ালে একটা কাগজ আঠা দিয়ে সাঁটানো আছে । তাতে কেউ কাঁচা হাতে কালো কালিতে লিখে রেখেছে,“TO LET HERE”। বেশ মোটা করে লেখা আর শব্দগুলোর মধ্যে অনেক ফাঁক। শ্যাম বলে “নেতাই, তোর কালো ফেল্ট পেনটা দে তো!”

নিত্য বলে “ সেটা দিয়ে এখন কী করবি?”

শ্যাম চাপা হাসি মুখে এনে বলে, “ দে এখন, দেখতেই পাবি একটু পরে।”

কালো কালির TO LET এর মাঝে খালি জায়গাতে কালো ফেল্ট পেন দিয়ে মানানসই এমন একটা ইংরেজি অক্ষর শ্যাম লিখল যে বিজ্ঞাপনটার মানে পালটে গেল। ছিল “TO LET HERE”, কিন্তু হয়ে গেল “TOILET HERE” .

শ্যামের কাণ্ড দেখে বাকি তিন বন্ধু কোনওরকমে হাসি চেপে বাগানের পেছন দিকের দেওয়ালে মইটা নিয়ে গেল। পেছনের দিকের গাছগুলো নিরাশ করেনি। মই বেয়ে নামতে-নামতে দেবা একটা আধ-খাওয়া পেয়ারা ছুঁড়ে মারল বাগানের ভেতরে। সেই দেখে বাকিরাও শুরু করল। পর-পর বেশ কিছু পেয়ারা গিয়ে পড়ল, মালীর টিনের ছাদের আস্তানায় । কিন্তু দুপুরের ভাঙের নেশায় মালীর ঘুম না ভাঙলেও একটা ঘেউ-ঘেউ আওয়াজ শুনে ওরা চারজন কোনওমতে নেমে বাড়ির রাস্তার দিকে দৌড়ালো ।

মালী তাহলে এখন একটা দেশী কুকুর পুষেছে । লম্বা গরমের ছুটির পর আজই ওরা প্রথম আসছে। এই খবর তো না জানবারই কথা । ওদের মধ্যে সব চাইতে ঠাণ্ডা মাথা শ্যামুর। ও সবাইকে দৌড়াতে বারণ করতে-করতে বলল, “ওরে তোরা থাম, আমার কথা শোন । অত উঁচু গেটটা, অ্যালসেসিয়ান কুকুরেও কোনোমতেই পার হতে পারবে না” ।

ততক্ষণে ওরা নালার পাশে ঢিপির কাছে এসে গেছে । ঢিপিটার চারপাশ ঝোপে ঢাকা থাকায় একটা সুবিধে হল। বাগানবাড়ির গেটের আশপাশ ওরা দেখতে পেলেও ওখান থেকে ওদেরকে দেখা কুকুরটার পক্ষেই বেশ মুস্কিল আর মালী বেচারার তো কথাই নেই। কুকুরটার চিৎকারে সে বেচারা কোনোরকমে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে টলতে-টলতে দৌড়োবার চেষ্টা করতে গিয়ে, গেটের সামনে এসে চিৎপাত হয়ে উলটে গেল। তার ভুঁড়ির হাপরের মতো ওঠা-নামা দেখে কুকুরটাও বিরক্ত হয়ে গরর-গরর করতে-করতে সরে গেল।

ঢিবির ঢালে বসে পেড়ে আনা ফলসা আর পেয়ারায় কামড় দিতে-দিতে ওরা তাই দেখছিল আর খুব কষ্টের সঙ্গে চাপা হাসি হাসছিল । পকেট ভরতি পেয়ারা আর গাছ-পাকা আমগুলো। তার থেকে ভালো ভালোগুলো দেখে ভাই-বোনদের দেবার জন্য স্কুলব্যাগে চালান করছিল দেবা আর নেতাই। শ্যামু আর কার্তিকের ভাই বোন নেই। তবে ওদের বিল্ডিং-সোসাইটির দারোয়ানদের বাচ্চাগুলোকে কিছু দেবে । ওদের মধ্যে এই সব কথাই হচ্ছিল। কিন্তু কার্তিকের রাডারের মতো চোখে ধরা পড়ে এক দারুণ দৃশ্য ।

ও বলে,
“সবাই সামনের দেয়ালের শেষটায় দেখ। শ্যামুর কারসাজিটা ধরতে না পেরে ওরা কিন্তু দেওয়ালে সাঁটানো নোটিসগুলোকে সিরিয়াসলি নিয়েছে”। 

স্কুল-বাসের ঠিক হয়ে যাবার আশা ছেড়ে দিয়ে দলে- দলে ওদের স্কুলের ছেলেরা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরেছে। তারা এখন বাগানবাড়ির সামনের দেওয়ালের শেষ থেকে শুরু করে গেটের প্রায় কাছে পর্যন্ত জায়গায় সমবেত টয়লেট করা শুরু করে দিয়েছে।এইসব দেখে মালীর কুকুর সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে । ভাঙের নেশায় ডুবে থাকা মালী মাথা তোলবার চেষ্টা করেও পারছে না। দেবা, কার্ত্তিক, শ্যামু আর নেতাই এতক্ষণ ধরে হাসি চেপে ছিল। এবার এই সব দেখে আর পেরে উঠলো না হাসি চাপতে।

নিজেদের টাউনশিপে ঢুকে শ্যামু আর নেতাই একটু জোরে পা চালিয়ে তাদের বাড়ির দিকে চলে গেল। কার্ত্তিক আর দেবা বাসস্ট্যান্ডের কংক্রিট বেঞ্চিতে বসে গেল। কেউ দেখলে ভাববে, এইমাত্র স্কুল-বাস থেকে নেমে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। আসলে ওদের এখনই ঘরে ফেরার তেমন তাড়া নেই। ওদের মায়েরা এখন কোনও এক আন্টির বাড়িতে তাস খেলায় ব্যস্ত।

কার্ত্তিক বলে “দেবা আজ দিনটা বেশ গেল কিন্তু!”

কার্ত্তিক বলে “ দেবা, শ্রী বাস্তব আঙ্কল আর আন্টি বেড়াতে বেরোল।”

“তাতে আমাদের কী?”

“তুই ভুলে গেলি? এই তো সেদিন, সেই হরতালের দিন আমরা ক্রিকেট খেলছিলাম এখানে । একটা বল গেট পেরিয়ে, ওদের বাগানে চলে গেছিল” ।

“বল তো আঙ্কল দিলই না, তার ওপর আন্টি কত গাল-মন্দ করল!”

কার্ত্তিক বলে, “আঙ্কলদের ফিরতে আধাঘণ্টারও বেশি হবে। সেবারে আন্টি যখন ধমকাচ্ছিল, তখন ভুট্টাগাছগুলোতে সবে মাত্র থোড় এসেছে।”

দেবা, কার্তিকের মতলবটা তখনো বুঝতে পারেনি। কার্ত্তিক সেটা বুঝে, নিজের স্কুলব্যাগ থেকে একটা লাল বল বের করে আশ্বাস দেয়,“আমরা মিনিট-খানেক ওদের বাংলোর পেছনে এই বল নিয়ে লোফালুফি খেলবো। কয়েকবার খেলার পর বলটা গেট পেরিয়ে ঢুকতেই পারে । আমি গেট টপকে ঢুকে যাব আর তুই চলে যাবি সামনের গেট থেকে একটু তফাতে। কেউ যদি দেখে থাকে, তবে সে এইটুকুই দেখবে। এইবারে বুঝলি হাঁদারাম?”

কার্ত্তিক এবার দেবার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে,“আমি একটা-একটা করে ভুট্টা ছুঁড়বো আর তুই আমাদের দু’জনের ব্যাগে ঢোকাতে থাকবি। আর যদি দেখিস আঙ্কল-আন্টি ফিরে আসছে, তবে আমাকে ইশারা করেই তুই স্মার্টলি সটকে পড়বি। আমি বাংলোর পেছনের গেট টপকে পালাব।”


দেবা নিজের বুড়ো আঙুল তুলে ইশারা করতেই কার্ত্তিক পি-টি স্যারের গলা নকল করে বলে, “এনি ডাউট বয়েজ? তব আগে বাঢ়, ডরকে আগে জিত হ্যায়।”

শ্রীবাস্তবদের বাংলো পেরিয়ে সামান্য এগিয়ে গেলেই পার্ক। পার্কের আগাছা কেটে সাফ করা, শুকনো ঘাস-জঙ্গল। ঝোপে আগুন লাগিয়ে মালী গেছে কোথাও হাত-মুখ ধুতে। সেই ধিকিধিকি আগুনে সেঁকে নেওয়া কচি ভুট্টাগুলো খেতে-খেতে ওরা দু’জনেই বলাবলি করছিল,

"একটু নুন আর লেবু হলে মন্দ হতো না।” 

একটা “হায়-হায়” ধ্বনি ভেসে আসতেই দু’জনে মুখ বাড়িয়ে দেখে, শ্রীবাস্তব আঙ্কলদের বাড়ির সামনে বেশ ভিড় ।

দেবা আর কার্ত্তিক শ্রীবাস্তবদের বাংলো থেকে ফেরবার সময় বেশ কিছু ভুট্টার সবুজ খোসা ওখানেই ছাড়িয়ে গেটের সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিল। আন্টি একবার গেটের দিকে দু’হাত দেখিয়ে, আর একবার কপালে চাপড়ে সমানে 'হায়- হায়’ করে যাচ্ছে। 


হঠাৎ দেবাও বলে ওঠে,“ হায় রে! শেষবারে, বলটা তোকে ছোঁড়বার জায়গায়, আর একটা কচি ভুট্টা ছুঁড়েছি।”

নতুন বল, তবুও সেই শোক সামলে কেতো দেবার পিঠ চাপড়ে দিতে গিয়ে দেখে ওদের পিছু-পিছু ভোলু আসছে। ভোলু এই পাড়ার দেশী কুকুর। কেতো ওর পকেটে রাখা একটা বিস্কুট ভোলুর দিকে এগিয়ে দিতেই সে লেজ নাড়ার সাথে-সাথে কেতো’র পায়ে মুখ ঘষতে থাকে। কেতোর পায়ে আর একবার মুখ ঘষে আর গর-গর আওয়াজ করতে-করতে শ্রীবাস্তবদের বাড়ির বাগানের পেছনের গেট লাফ দিয়ে পেরিয়ে ভুট্টা গাছগুলোর দিকে দৌড়ে চলে যায় । বিস্কুটদুটো পড়েই থাকে। মিনিট-খানেকের কম সময়ে বাগান থেকে সে ফিরে আসে। তার মুখে কেতোর সেই ফেলে আসা বল। বলটা কেতোর পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে, একবার ভৌ করেই এবারে বিস্কুট কামড়ানোয় মন দেয় ভোলু ।

বিস্মিত ওরা দুজন “সাবাস ভোলু” বলা ছাড়া আর কিছু বলতে পারেনি। এতদিন, ভোলুকে ওরা আসলে একটা অবোধ পশু ভেবেছে। সত্যি-সত্যি বন্ধু ভাবেনি। এই সত্যটা তাদের সামনে আসতেই কিছুটা লজ্জা আর আর অনেকটা অনুশোচনা এই দুটোই তাদের দুজনকে বাড়ির রাস্তার শেষ-অবধি সাময়িক বোবা করে রেখেছিল ।


অলঙ্করণ : সুস্মিতা কুণ্ডু

No comments:

Post a Comment